অসহায়: কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে রিঙ্কু দেবী। তখন তিনি জীবিত। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
বিকেল ৪টে বেজে ১৯ মিনিট। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াল একটি অ্যাম্বুল্যান্স। রোগীর পরিজনেদের মধ্যে রোগীকে ভর্তি করানোর প্রবল তৎপরতা। কিন্তু জরুরি বিভাগ থেকে ছুটতে ছুটতে সেখানে পৌঁছলেন পিপিই পরা এক জুনিয়র চিকিৎসক। তিনি বললেন, ‘‘দাঁড়ান, কেউ নামবেন না। কী কেস?’’ পুড়ে যাওয়া রোগীকে দেখে তিনি চেঁচাতে শুরু করলেন, ‘‘রোগীর কি করোনা আছে? যদি না থাকে সোজা এনআরএসে চলে যান। এখানে করোনা ছাড়া ভর্তি হবে না।’’
ওই রোগীর পরিবারের অভিযোগ, তার পরে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঘুরেও কোথাও ভর্তি করানো যায়নি রিঙ্কু দেবী নামে বছর আটত্রিশের ওই মহিলাকে। অভিযোগ, মেডিক্যালের পরে ছ’টি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা মেলেনি। শেষে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (এনআরএস) নিয়ে গেলে মৃত্যু হয় তাঁর।
করোনা অতিমারির পরিস্থিতিতে শহরের সরকারি হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত জরুরি চিকিৎসা মিলছে না বলে অভিযোগ উঠছে বারবারই। গুরুতর আহতকেও এক সরকারি হাসপাতাল থেকে অন্য সরকারি হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন রোগীর আত্মীয়দের একটি বড় অংশ। সেই প্রেক্ষিতেই সম্প্রতি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা গেল, রিঙ্কু দেবীর মতো বহু রোগীই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অভিযোগ, এসএসকেএমেও জরুরি বিভাগে কেউ এলেই হয় তাঁকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত নয়তো অন্য সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তিকেও দীর্ঘ অপেক্ষার পরে এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে ঘোরাতে দেখা গেল। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, কোনও ওয়ার্ড বয় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। যে ট্রলি দেওয়া হয়েছিল সেটিরও একটি চাকা ভাঙা। কোনও মতে দুই বয়স্ক মিলে রোগীকে নিয়ে ঘুরেছেন।
আরও পড়ুন: ভয়ে অনুপস্থিত আইনজীবীরা, আলিপুরে জমে মামলার পাহাড়
রিঙ্কু দেবীর ছেলে শেখর জানান, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ফিরিয়ে দেওয়ার পরে স্টোভ ফেটে অগ্নিদগ্ধ হওয়া মাকে নিয়ে তাঁরা বড়বাজারের বিশুদ্ধানন্দ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে পরিকাঠামো না থাকার কথা জানানো হয়। এর পরে আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি হাসপাতালে জানানো হয়, চিকিৎসক নেই। সেখান থেকে তাঁরা যান এসএসকেএমে। শেখরের অভিযোগ, জরুরি বিভাগ থেকে জানানো হয় রিঙ্কু দেবীকে আইসিইউ-তে রাখা দরকার, কিন্তু আইসিইউ ফাঁকা নেই। শম্ভুনাথ পণ্ডিত বা এনআরএসে যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়। রিঙ্কু দেবীর আর এক ছেলে সৌরভের দাবি, ‘‘শম্ভুনাথ পণ্ডিতে অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। মাকে আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালেও ভর্তি নেয়নি। শেষে এনআরএসে গেলে চিকিৎসকেরা বললেন, মা আর নেই।’’
ওই দিনই মণিকা লস্কর নামে বছর কুড়ির এক তরুণীকে নিয়ে এসএসকেএমে গিয়েছিলেন বাড়ির লোকজন। ঝলসে গিয়েছে তাঁর পিঠ-বুক-কোমর। জরুরি বিভাগের সামনেই কিছু ক্ষণ ফেলে রাখার পরে তাঁদের পাঠানো হয় বার্ন ওয়ার্ডে। সেখানেও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পরে শম্ভুনাথ পণ্ডিত বা আর জি কর হাসপাতালে যেতে বলা হয়। চিকিৎসকের কাছে যখন কান্নাকাটি করছেন তাঁর মা, মণিকা তখন যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলছেন, ‘‘আমার কোলের বাচ্চা ঘরে রেখে এসেছি। আমি গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে বলি, আমার জ্বালা একটু কমিয়ে দিন ডাক্তারবাবু!’’
জরুরি পরিষেবার এই হাল কেন? রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বললেন, ‘‘মিটিংয়ে ব্যস্ত রয়েছি।
আরও পড়ুন: অসহায় পরিবারে মিথ্যা ভরসা দিয়ে জমি তৈরি করছে পাচারকারীরা
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকে ধরুন।’’ রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘একটু ব্যস্ত রয়েছি।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সুপার ইন্দ্রনীল বিশ্বাসের অবশ্য দাবি, ‘‘করোনা হলে তবেই কোনও অগ্নিদগ্ধকে ভর্তি নিচ্ছি। কোভিড আর নন-কোভিড মেলালে মুশকিল।’’ কিন্তু এ ভাবে ফিরিয়ে দেবে জরুরি বিভাগ? ইন্দ্রনীলবাবুর দাবি, ‘‘সে দিন কী হয়েছিল, কোন চিকিৎসক ছিলেন খোঁজ নিচ্ছি।’’ এসএসকেএমের সুপার রঘুনাথ মিশ্রও দ্রুত খোঁজ নেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘শয্যার অভাব নতুন নয়। তবে এসএসকেএমে জরুরি পরিষেবার কাজে গাফিলতি নেই।’’