পোস্তা উড়ালপুল দুর্ঘটনা। ফাইল চিত্র।
পোস্তা উড়ালপুল ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। বহু টাকা খরচ করে নির্মীয়মাণ একটি উড়ালপুল কেন ভেঙে পড়ল, কেনই বা পুরোটা এত দিন বাদে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হল? তা হলে কি হাওড়া স্টেশনের সঙ্গে কলকাতার যে সহজ যাতায়াতের পথ তৈরি হচ্ছিল, তার আর প্রয়োজন নেই? সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরে এমন হাজারো প্রশ্ন আসছে। কারণ, উড়ালপুলটি তৈরি হলে উত্তর কলকাতা ও শহরতলির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হাওড়া স্টেশনকে যুক্ত করত।
যদিও অর্ধনির্মিত ওই উড়ালপুল ভেঙে ফেলার প্রয়োজন আছে, আমিও মনে করি। কিন্তু রাস্তার দু’ধারের ইস্পাতের স্তম্ভ ও তার বিরাট ভিত যা মাটির গভীর পর্যন্ত গিয়েছে, তা ভাঙতে খুব সতর্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এই অভিমুখে অবশ্যই নতুন উড়ালপথের প্রয়োজন আছে। ফলে পোস্তা উড়ালপুলের বর্তমান কাঠামো ভেঙে ফেলার সঙ্গে নতুন উড়ালপুল তৈরির যোগসূত্র রয়েছে কি না, থাকলে সেটা কী, এই দু’টি প্রশ্নের উপরে ভিত্তি করে বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন প্রয়োজন। নির্মীয়মাণ কাঠামোর কোন অংশ কতটা ভাঙা হবে, তার মধ্যেই নতুন উড়ালপুল পরিকল্পনার বীজ লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়।
বর্তমান পরিকাঠামো পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা: নির্মীয়মাণ পোস্তা উড়ালপুলের অংশ পুরো ভেঙে ফেলার আগে ওই জায়গায় আরও একটি উড়ালপুলের প্রাথমিক পরিকল্পনা করে ফেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনই পরিকল্পনা ছকে ফেলতে পারলে বর্তমান পরিকাঠামোর কোন অংশ, কী ভাবে ব্যবহার করা হতে পারে বা আদৌ ব্যবহার করা সম্ভব কি না, তা বোঝা যাবে। এ ক্ষেত্রে দু’টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, বর্তমান কংক্রিটের ভিতকে কম ভারের জন্য ব্যবহার করতে কোনও অসুবিধা নেই। আর দ্বিতীয়ত, যে পিলার বা পায়ার (উড়ালপুলের স্তম্ভকে পায়ার বলে) ও অনুভূমিক বিমগুলি ভিত থেকে উঠেছে, সেগুলির বর্তমান শক্তি পরখ করা ও প্রয়োজনে তা শক্তিশালী করা। যে হেতু এটা ইস্পাতের তৈরি, তাই শক্তি বৃদ্ধির কাজটা খুব সহজ। ইস্পাতের অন্যতম বৈশিষ্ট এটাই। আমার অনুমান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দু’টি বিষয়েই সজাগ আছেন।
এখন উড়ালপুলের কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রাস্তার দু’প্রান্তে দু’টি স্তম্ভের উপরে একটি অনুভূমিক বিম রয়েছে, তার উপরে রয়েছে উড়ালপুলের ডেকটি। এই দু’টি স্তম্ভ ও তার উপরের বিম মিলিয়ে একে বলা চলে পোর্টাল পায়ার। একক পিলারের উপরে যে অংশটি ছিল, দুর্ঘটনার সময়ে সেটাই ভেঙে পড়েছিল। বাকি অংশ ঠিকই রয়েছে। ফলে নতুন উড়ালপুলের ক্ষেত্রে ভেঙে পড়া অংশের জায়গায় আর একটি পোর্টাল পায়ার তৈরি করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে সেই নতুন উড়ালপুলের ওজন যেন অনেকটাই কম হয়। অর্থাৎ, বর্তমান কাঠামোর উপরে যেন কোনও বাড়তি চাপ না পড়ে। এমনকি, যে ভার বহনের জন্য এটা তৈরি হচ্ছিল, নতুন উড়ালপুলকে যেন তার থেকে অনেকটা কম বহন করতে হয়। মনে রাখা জরুরি, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রাস্তার অনেক গভীরে থাকা উড়ালপুলের বর্তমান ভিতের কাঠামো ব্যবহার না-করা গেলে, ভবিষ্যতে এখানে উড়ালপুলের নতুন ভিত তৈরির কাজটা প্রায় অসম্ভব হবে।
নতুন উড়ালপুল: এই রুটে একটি নতুন উড়ালপুল নির্মাণ করা তখনই সম্ভব, যদি সেটি দু’লেনের (আপ বা ডাউন) হয়। চার লেনের উড়ালপুল এই ঘিঞ্জি এলাকায় সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমান উড়ালপুলের ডেকে যে কাঠামোটি রয়েছে, সেটি চার লেনের ও প্রায় ১৬ মিটার চওড়া। এ দিকে ওই রাস্তা ২০ মিটার বা তার থেকে একটু বেশি চওড়া। অর্থাৎ, ডেক-কাঠামো ও রাস্তার ধারের বাড়িগুলির মধ্যে ব্যবধান খুবই কম। এটা কখনওই কাম্য নয়। ফলে দু’লেনের উড়ালপুল হলেও সেটি কতটা চওড়া হবে, ভাবা দরকার। সব থেকে নিরাপদ হবে, যদি নতুন উড়ালপুলের ডেকের চওড়া সব মিলিয়ে আট মিটারের মতো হয়। অর্থাৎ, পুরনো কাঠামোর থেকে চওড়ায় অর্ধেক। তা হলে বর্তমান উড়ালপুলের প্রায় গা ঘেঁষে যে বাড়িগুলি দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেগুলিও উড়ালপুলের ডেক থেকে আবশ্যিক নিরাপদ দূরত্বে থাকবে।
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অতিথি অধ্যাপক