অবসর-এর পুজোমণ্ডপ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
শহরের রাস্তা দিয়ে মোটরবাইক চালাচ্ছেন এক যুবক। পিছনে বসা যুবকের কাঁধে ব্যাগ। তাতে রয়েছে গাদা গাদা পুজো-প্রতিযোগিতার ফর্ম আর নানা ধরনের রবার স্ট্যাম্প।
ওই যুবকদের কেউই পুজো কমিটির নন। তাঁরা বিভিন্ন পুজোর ‘এজেন্ট’। পুজো এলেই প্রতিযোগিতার হিড়িক পড়ে। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার প্রতিযোগিতায় আলাদা নিয়ম। ফর্ম ভর্তি থেকে জমা দেওয়া, ব্যানার আনা— সব দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে। ‘এজেন্ট ফি’ হিসেবে পুজোপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা।
কলকাতার পুজোর চালচিত্র ফি বছর বদলাচ্ছে। কখনও ঢুকে পড়ছে ফেসবুক-অ্যাপ, কখনও পুজোর গানের পাশাপাশি জাঁকিয়ে বসছে থিম সং। এমন ভাবেই আসছে কর্পোরেট ধাঁচের পেশাদারিত্বও। তা সে পুজো প্রতিযোগিতার এজেন্ট নিয়োগই হোক বা পুজোকে তুলে ধরতে ‘ব্র্যান্ডিং-মার্কেটিং-কমিউনিকেশন’ পেশাদার নিয়োগ। যেমন, এ বার শহরের অন্তত ৯৪টি পুজোর হয়ে প্রতিযোগিতার কাজ করছেন ওই দুই যুবক। পুজোপ্রতি প্রচারের দায়িত্ব সামলাতে গড়ে ১৫-২০ হাজার টাকা করে নেন পেশাদারেরা।
সাত-আটের দশক তো বটেই, নয়ের দশকেও পুজো বলতে বোঝাত শরৎকালে পাড়ার একদল ছেলের উদ্যোগে গড়ে ওঠা উৎসব। থিমের হাত ধরে সেই পুজোর বদল শুরু। থিম যত জাঁকিয়ে বসেছে, ততই পুজোর খুঁটিনাটি নিয়ে মানুষের উৎসাহ বেড়েছে। জোরালো হয়েছে প্রচারের আলো। সেই প্রচারের আলো কাড়াকাড়িতেও লড়াই শুরু হয়েছে মণ্ডপে মণ্ডপে।
পুজোকর্তারাই বলছেন, থিম কী ভাবে তুলে ধরতে হবে, কী ভাবে লোকের মনে পুজো নিয়ে আগ্রহ বাড়বে— এ সবই এখন গবেষণা করে ঠিক করা হয়। যে ভাবে এ বছর গরম পড়তেই শহর জুড়ে ‘সব থেকে বড় সত্যি’র ব্যানার পড়েছিল। যে ভাবে ‘পরমাণু বড় হয় না’ দেখে চমকে গিয়েছিলেন অনেকে! প্রশ্ন উঠছে, শুধুই কি সংস্কৃতি? নাকি এই কর্পোরেট পেশাদারিত্বের পিছনে আছে অন্য কোনও কারণ?
পুজো ময়দানে ঘুরেফিরে শোনা গেল, নবীন প্রজন্মের ঘাটতি এর পিছনে অন্যতম কারণ। প্রবীণদের অনেকেই বলছেন, চলতি শতকের শুরুতেও পুজোর লড়াই হোক বা প্রচারের ঢাক পেটানো— ক্লাবের লোকজনেরাই কাঁধে জোয়াল তুলে নিতেন। বাংলা ক্যালেন্ডার শুরু হতেই শিল্পী ধরতে নেমে পড়তেন এক দল। অন্য দল মাঠে নামত একটু পরে। তাঁদের কাজ, পুজোর প্রচার করতে সংবাদপত্রের অফিসে ঘুরে বেড়ানো আর প্রতিযোগিতায় নামার প্রয়োজনীয় নথি জোগাড়। কিন্তু গত কয়েক বছরে তরুণ প্রজন্ম পুজোয় সে ভাবে উঠে না আসায় বহু পুজোর দায়িত্বই প্রবীণদের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। তাই বুড়ো হাড়ে ঝক্কি এড়াতে পেশাদার নিয়োগের কথা ভাবছেন তাঁরা। শহরের এক প্রবীণ পুজোকর্তার মন্তব্য, ‘‘এই বয়সে অত ছোটাছুটির ধকল নিতে পারি না। তাই টাকা দিয়েই পরিষেবা কিনতে হয়।’’
আবার কেউ কেউ বলছেন, থিম পুজো করতে করতে অভিজ্ঞ হয়ে যাওয়া ক্লাবকর্তারাই পেশাদারদের দশ গোল দিতে পারেন। যেমন, নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘের পুজোর কাজে আলাদা আলাদা দল রয়েছে। উপচে পড়া ভিড়ে কোনও দল যদি ভিআইপি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকে তো অন্য দল নজর রাখছে মণ্ডপ পরিদর্শনে আসা প্রতিযোগিতার বিচারকের দিকে। কিন্তু যে সব পুজো সাবেকিয়ানা ছেড়ে থিম পুজোয় আসছে, তাদের কিন্তু প্রচার সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। ফলে নিজের পুজোয় আলো কাড়তে ওই সব ক্লাবের কর্তারা পেশাদারদের উপরেই ভরসা করছেন।
যেমন, উত্তর কলকাতার সিমলা স্পোর্টিং ক্লাব এ বছরই থিম পুজো শুরু করছে। পরিবেশ সচেতনতায় গাছকে তুলে ধরে সেখানে সাজছে মণ্ডপ। থিম তুলে ধরতে তাঁরা যেমন পেশাদার সংস্থার হাত ধরেছেন, তেমনই আফ্রিকার অরণ্য তৈরি করে চমক দিতে চাওয়া মহম্মদ আলি পার্কের মতো নামী পুজোর প্রচারেও আছে পেশাদার সংস্থা।