অন্ন-জীবন: ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে রাস্তার মধ্যেই পাতা থালায় খিদে মেটানোর চেষ্টা (বাঁ দিকে)। ২০২০ সালের লকডাউনে খাবার সংগ্রহের জন্য থালা হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে মা, কোলে একরত্তি সন্তান (ডান দিকে)। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে এবং রণজিৎ নন্দী
১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ। বাংলায় ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের ২৮ ফাল্গুন। কলকাতা পুরসভার অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, নির্দিষ্ট দামে ও বেশি পরিমাণে অত্যাবশ্যক খাদ্যদ্রব্য বিক্রির জন্য আরও বেশি সংখ্যায় দোকান খোলা থাকবে। পরের দিন সংবাদপত্রে লেখা হল— ‘কলিকাতা ও শিল্পাঞ্চলে চাউল, আটা, ডাল, সরিষার তৈল ও পাথুরিয়া কয়লা সম্পর্কে নির্দিষ্ট রসদ বিতরণের ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করা প্রয়োজন।’
তারই মাসখানেক বাদে, ২৭ চৈত্রে (১০ এপ্রিল) খবর হল, ‘দুই সহস্র লোকের চাউলের কল আক্রমণ’। কারণ, গুজব রটেছিল, বিনামূল্যে ধান ও চাল বিতরণ করা হবে। সেই গুজব শুনেই সংশ্লিষ্ট চালকলের সামনে জনতা ‘চাউল ভিক্ষা করিবার জন্য সমবেত হয়।’ কিন্তু তা না পেয়েই চলে লুটপাট। তার পাঁচ দিন পরে, ১৩৫০ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে (১৫ এপ্রিল) সংবাদপত্রের ‘নববর্ষ’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখা হল, ‘পরাধীন জাতি পিঠ বাঁকা করিয়া অন্ন খুঁটিবার চেষ্টায় রাজপথে পিপীলিকার ন্যায় সারি বাধিয়া চলিয়াছে।’
সেই বছরেরই বিভিন্ন সময়ে কখনও সাত বস্তা চাল লুট, কখনও শহরের খাদ্য সমস্যা সমাধানে কলকাতা পুরসভার চেষ্টা, বাংলায় খাদ্য সঙ্কট, বাংলার নানা স্থানে চাল, ডাল, আলু ডাকাতি-সহ একাধিক খবরে ভরে গিয়েছিল সংবাদপত্রের পাতা। যা নিয়ে পরে ইতিহাস জানায়, খাদ্যসঙ্কট যা সে সময়ে মন্বন্তরের আকার ধারণ করেছিল, তাতে বেশ কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। যা ফিকে করে দিয়েছিল নববর্ষ-সহ গোটা বছরের সমস্ত উৎসবকে ঘিরে উৎসাহ। ইতিহাসবিদেরা বলছেন, এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, বিপন্নতার মধ্যে পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব কোথায়!
আরও পড়ুন: এ বার পয়লা বৈশাখেও ঘরবন্দি থাকতে হবে ভেবে বিষণ্ণতা আছেই
প্রেক্ষিত আলাদা। কিন্তু অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা, বিপন্নতার সেই নববর্ষই যেন একদম আলাদা চেহারায় ফিরে এসেছে এ বছর। যেখানে আজ, মঙ্গলবার, নববর্ষে স্তিমিত বাঙালি-আবেগ। বরং কোভিড ১৯-এর সংক্রমণের সামনে কী ভাবে টিকে থাকা যাবে, কী ভাবে অক্ষত রাখা যাবে নিজেকে ও পরিবারকে, সেটাই প্রধান চিন্তা শহরবাসীর।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় জানাচ্ছেন, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের বৈশাখেও প্রবল অনিশ্চয়তা, খাবার পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে ভীতি ছিল। রজতবাবু জানাচ্ছেন, ‘এনটাইটেলমেন্ট’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ওই শব্দের সহজবোধ্য ব্যাখ্যা হল, মানুষের ক্ষুধার্ত থাকার কারণ কম উৎপাদন নয়। এর কারণ, বাজারে যে খাদ্য রয়েছে, কোনও কিছুর বিনিময়েই তারা তার সংস্থান বা অধিকার আদায় করতে পারে না। আর খাবার পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের কারণে ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে মানুষ মারা গিয়েছিল। রজতবাবুর কথায়, ‘‘কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এখনও পর্যন্ত আফ্রিকা বাদ দিয়ে বাকি সব দেশেই খাদ্যদ্রব্য মোটামুটি মজুত রয়েছে। ফলে এ বারের সমস্যা কিন্তু খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নয়। এ বারের সমস্যা হল লকডাউন।’’
আরও পড়ুন: যে দিন সুস্থ আকাশের নীচে সমবেত প্রশ্বাস নিতে পারব, সে দিনই নতুন করে পয়লা ঘোষিত হবে
আর লকডাউনের শহরে বৈশাখী খাওয়া-দাওয়া নয়, বরং ঘরে চাল-ডাল পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত আছে না কি আরও কিনে রাখতে হবে, সরকারের আশ্বাস সত্ত্বেও পরে দাম বেড়ে যাবে কি না তা নিয়ে সংশয়— এই অনিশ্চয়তায় ভুগছেন নাগরিকদের একটা বড় অংশ। তার পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষদের জন্য খাদ্য সরবরাহ ও বিতরণকে কেন্দ্র করেও প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারই খাদ্য সরবরাহ ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে বারণ করেছেন সকলকে। প্রান্তিক মানুষদের কাছে বিনা মূল্যে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকারও। কিন্তু তার পরেও সংশয় কাটছে না।
ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস জানাচ্ছেন, যখনই সঙ্কট বা বিপর্যয়ের সামনে পড়েছে মানুষ, তখনই সে নতুন করে চিন্তা করতে শিখেছে। তা সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট যা-ই হোক না কেন! সুরঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘অন্ধকার, অনিশ্চয়তা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রতিটি সঙ্কটের সময়ে ইতিহাস দেখিয়েছে, মানুষ বিপদে পড়েছে, আবার মানুষই মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এই আলোটুকুও কিন্তু রয়েছে।’’
মন্বন্তরের ঠিক এক বছর পরে, ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল, বাংলা ক্যালেন্ডারের পয়লা বৈশাখের দিন সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়— ‘বাংলায় এবারে আর গত বৎসরের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইবে না।’ তার ঠিক ৭৬ বছর বাদে, আজ, নববর্ষে সকলের চাওয়াও শুধু একটাই, দ্রুত এই বিপর্যয় কাটুক। বিপর্যয় কেটে এই আশ্বাস, এই ভরসাটুকু ফিরে আসুক— ‘মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইবে না।’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)