পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁয় কর্মীদের জীবাণুমুক্ত করার বিশেষ ব্যবস্থা। নিজস্ব চিত্র
প্রশ্নটা এখনও সুরক্ষা ঘিরেই। তখন জঙ্গি হানা, এখন জীবাণু সংক্রমণ। করোনা-বাস্তবতার পটভূমিতে শুধু বদলে গিয়েছে ভয়ের অভিমুখটা।
৯/১১-র পর থেকেই বদলে যাচ্ছিল বিমানবন্দর, মেট্রো রেল থেকে স্টেডিয়াম, হোটেলে নিরাপত্তার খোলনলচে। মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেন বা দিল্লি-হায়দরাবাদের জঙ্গি নাশকতা সিসি ক্যামেরা, মেটাল ডিটেক্টর, লাগেজ স্ক্যানারে ভরে গিয়েছিল দেশের স্পর্শকাতর অফিসগুলি। ২০২০-তে দাঁড়িয়ে সেই ভয়ই অন্য রকম। স্টার্টআপ সংস্থার অফিস, আনকোরা কফি শপ কিংবা শহরতলির আবাসনও ভাইরাস-ভয়ে সন্ত্রস্ত। ছোটখাটো দোকান বা শো-রুমটিকেও ভাইরাস এড়ানোর ছক কষতে হচ্ছে। রেস্তরাঁয় ভোজ বা সেলুনে চুল কাটার সময়েও ভাইরাস-যুদ্ধে কখনও উপভোক্তাকে বইতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। সেই সঙ্গে দানা বাঁধছে ধন্দ।
কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউসিং কর্পোরেশনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার কর্তা বিবেকানন্দ মিশ্র বলছিলেন, ‘‘আগে অফিস-কাছারি কীটাণুমুক্ত করার চাহিদা ছিল। এখন কোভিড-স্যানিটাইজ়েশনের ২০০ শতাংশ চাহিদা বেড়েছে দেশে, কলকাতাতেও।’’ তবে রেস্তরাঁ-মলে কয়েক ঘণ্টা অন্তর জীবাণুনাশের আয়োজন দেখা গেলেও ছোট-বড় অফিসে সংক্রমণ রোধে রাসায়নিক ছড়িয়ে কাজটা তত নিয়মিত নয়। বিবেকানন্দবাবুর মতে, ‘‘২০-২৫ জনের অফিসও রোজ জীবাণুমুক্ত করা উচিত। এ কাজে হঠাৎ সক্রিয় বিভিন্ন সংস্থার তালিম নিয়েও প্রশ্ন থাকছে।’’ ১০০০ বর্গফুটের অফিস এক বার জীবাণুমুক্ত করতে বেসরকারি সংস্থায় খরচ দু’-তিন হাজার টাকা। সংগঠিত-অসংগঠিত শ’খানেক উদ্যোগ গোটা শহরেই ছড়িয়ে।
তবে মেঝে, গাড়ি বা ব্যক্তির শরীরে ছড়ানোর রাসায়নিকের নামধাম আলাদা। মুখস্থ করতে হিমশিম ছোট-বড় অফিসমালিক। পিতল, অ্যালুমিনিয়াম থেকে প্লাস্টিক বা ধাতব স্তরে নোভেল করোনাভাইরাসের আয়ুর অঙ্ক কষাও চলছে। কেয়াতলার একটি রেস্তরাঁর কর্তা পৃথ্বীশ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রক বা ফুড সেফটি অথরিটি— নানা জনের মতে মিল থাকলেও সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য কিছু নেই। রাসায়নিকগুলির রং পর্যন্ত আলাদা। স্কুলের কেমিস্ট্রি ক্লাসের দুর্দশা মনে পড়ছে।’’ তবে তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের বিভিন্ন অফিস শোধনের কাজে স্থানীয় প্রশাসন নবদিগন্ত কর্তৃপক্ষের সাহায্যে সন্তুষ্ট ন্যাসকমের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা নিরুপম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘মাস্ক পরার মতো জীবাণুনাশক প্রয়োগে ডিপ-ক্লিনিংও আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে।’’
আরও পড়ুন: সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই খুলছে গণ শৌচালয়
নিরাপত্তারক্ষীদের একটি সংস্থার কর্তা সতনম সিংহ অহলুওয়ালিয়া তাঁর কর্মীদের জীবাণুনাশের তালিম দিচ্ছেন। অনাথাশ্রম, বিশেষ ভাবে সক্ষমদের হোমও তাঁরা নিখরচায় স্যানিটাইজ় করছেন। ফিটনেস সরঞ্জামের ব্যবসা থেকে তিন মাস আগে স্যানিটাইজ়ার-শিল্প রপ্ত করেছে একটি সংস্থা। তাদের কর্তা গগন সচদেব বলছেন, ‘‘সময়াভাবেই দিনে পাঁচ-ছ’টির বেশি কাজ নিতে পারছি না।’’
চুল কাটা ও সৌন্দর্যচর্চার একটি সর্বভারতীয় সালোঁর রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের শাখায় ব্যক্তিপিছু ভাইরাস-রোধের আয়োজনে বাড়তি ৫৫ টাকা খরচ হচ্ছে। সংস্থার কর্তা গোপাল শীলের কথায়, ‘‘গ্রাহককে এক বার পরার এপ্রন, নেক পেপার, কাটিং শিট দিচ্ছি। যিনি চুল কাটছেন, তাঁর গ্লাভসও এক বার ব্যবহারের।’’ কয়েকটি সালোঁয় ১০০-১৫০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। আবার, আখের তৈরি ডিসপোজ়েবল বাসনের জন্য বাড়তি ৩০-৩৫ টাকা বা সামগ্রিক শুদ্ধতার আয়োজনের মাসুল জনপ্রতি বিল বাড়াচ্ছে কিছু রেস্তরাঁয়। ওয়াটারলু স্ট্রিটের চিনে রেস্তরাঁয় টেবিলের ফাঁকে স্বচ্ছ পর্দার আড়াল। সঙ্গীতশিল্পী বিক্রম ঘোষের স্টুডিয়ো-কাম-অফিসে জীবাণুরোধক পাপোশ থেকে ফগিং মেশিনে রাসায়নিক-যুক্ত ধোঁয়ার সুরভি। পার্ক স্ট্রিটের চিনে রেস্তরাঁর কর্তা মাইকেল লিউও ফগিং মেশিন থেকে নগদ টাকা শোধনের জন্য অতিবেগুনি রশ্মির যন্ত্র বসিয়েছেন।
তবে স্যানিটাইজ়েশন চ্যানেল বা ফগিং মেশিনে রাসায়নিকের মাত্রা কতটা নিরাপদ, তা নিয়েও জনমানসে সংশয়। জনস্বাস্থ্য চিকিৎসক মধুমিতা দোবের কথায়, ‘‘প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে যা-ই করা হোক, ঠিক মতো এবং বারবার হাত ধোয়ার সতর্কতার বিকল্প নেই।’’