পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরের বধূর বেশে ত্রাণভিক্ষা করতে হাজির হয়েছেন উমা। নিজস্ব চিত্র।
এ যেন বাস্তবের আয়নায় দুর্গাদর্শন! লকডাউনের সময় গত কয়েক মাস ধরে পেটের জ্বালায় যে ভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের ছটফট করতে দেখেছে গোটা দেশ, ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বড়িশা ক্লাবের দুর্গাপুজোয়।
শিল্পীর কল্পনায় সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরের বধূর বেশে ত্রাণভিক্ষা করতে হাজির হয়েছেন উমা। তাঁর কোলে কার্তিক। লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশকে নিয়ে মণ্ডপে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুর্গা। যদি ত্রাণ পাওয়া যায়! কিন্তু তাঁকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের মতোই। জবাব দিতে হচ্ছে প্রশ্নের— কোথায় যাচ্ছেন? কী দরকার? উত্তরে পরিযায়ী শ্রমিকের ঘরনি উমা বলছেন, “মায়ের কাছে যাচ্ছি গো। ত্রাণ নিতে। ত্রাণ দেবে গো?” মায়ের সঙ্গেও লক্ষ্মী, সরস্বতী বলে উঠছেন, “ত্রাণ নিতে গো।” শিল্পী রিন্টু দাস পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবি তৈরি করেছেন প্রতিমা এবং তার সঙ্গে শব্দের মায়াজাল বুনে। পুজোমণ্ডপে ঢোকার মুখে ঘোষণা শোনা যাচ্ছে, ‘‘আজ বিকেলে ত্রাণ দেওয়া হবে। ত্রাণ পাবেন। আসুন-আসুন।’’
শিল্পীর কথায়, “এই ছবিই তো দেখা গিয়েছিল শহর থেকে গ্রামের আনাচেকানাচে। দেশজুড়ে। খিদের জ্বালায় লম্বা লাইন দিতে হয়েছে ওঁদের। সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছি।”
মণ্ডপের ভিতরে ঢুকতেই ভিড়ের কোলাহল। হাঁকডাকের শব্দের মধ্যে কানে ভেসে আসছে, ‘‘লাইনে দাঁড়ান। ভিড় করবেন না। ধীরে ধীরে আসুন।’’ ত্রাণপ্রার্থীদের সামলাতে গিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের গলায় বিরক্তির বহিঃপ্রকাশও তুলে ধরেছেন শিল্পী। উমার কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, ‘‘কোথায় যাচ্ছেন? কী দরকার।’’ শুনে উমা থমকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সে ভাবেই তৈরি করা হয়েছে প্রতিমা।
রিন্টুর তত্ত্বাবধানে শিল্পী পল্লব ভৌমিক মায়ের মূর্তি বানিয়েছেন কৃষ্ণনগরের তাঁর স্টুডিয়োতে। নিজস্ব চিত্র।
করোনা পরিস্থিতিতে এ বছর বারোয়ারি পুজো আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল ক্লাবকর্তাদের। বড়িশা ক্লাবের সদস্যরাও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। শিল্পী রিন্টু যখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এ বার থিমের জন্য বেশি টাকা খরচ করা যাবে না। ততদিনে ২৫ হাজার কিলোগ্রাম চাল পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁদের পরিবার এবং গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। ফলে তহবিল সীমিত। আর্ট কলেজের ছাত্র, কলকাতার থিম পুজোয় পরিচিত মুখ রিন্টু শনিবার তাঁদের বলেছিলেন, পরিযায়ী শ্রমকিদের নিয়ে তিনি এ বারের পুজোর থিম ফুটিয়ে তুলতে চান। যে চাল গরিব মানুষকে দেওয়া হয়েছে, তার বস্তাগুলি দিলেই তাঁর কাজ হয়ে যাবে। গত কয়েক বছর ক্লাব তাঁকে পরিশ্রমিক দিয়েছে। এ বার তাঁর ক্লাবকে কিছু দেওয়ার পালা।
আরও পড়ুন: পুজোর উপহার নতুন গাড়ি চেপেই ঘুরবে ওরা
রিন্টুর তত্ত্বাবধানে শিল্পী পল্লব ভৌমিক মায়ের মূর্তি বানিয়েছেন কৃষ্ণনগরের তাঁর স্টুডিয়োতে। তৈরি হয়েছে মায়ের অবয়ব। ঠিক ঘরের মেয়ের মতো। সনাতনী মূর্তির বদলে বাস্তবানুগ করা হয়েছে। সঙ্গে সন্তানসন্ততিরা। মায়ের পরনে শাড়ি রয়েছে। কিন্তু শিল্পী তাতে রঙ দেননি। সে শাড়ির রং মাটির। তাতে মাটির ছোঁয়া। মাটির গন্ধ। আমজনতার যেমন হয়। শিল্পীর মতে, বেরঙিন এই শাড়ি হল আসলে পরিযায়ী শ্রমিকদের হয়ে ‘প্রতিবাদ’। পুজো কমিটির সভাপতি সুদীপ পোল্লে বলেন, “এ বছর আমাদের কিছুই করার ছিল না। বাজেট নেই। তার উপর লকডাউনের সময় আমরা প্রায় প্রতিদিনই ত্রাণ দিয়েছি অভাবী মানুষকে। রিন্টুকে আমরা ৫,০০০ খালি বস্তা দিয়েছিলাম। তাতেই উনি কম বাজেটে এত ভাল পুজোর থিম উপহার দিয়েছেন। পুজোর সময়ও আমরা গরিব মানুষকে ত্রাণ দেব প্রতিদিন।”
ক্লাবের সদস্যরা ত্রাণ বিলি করবেন মহাপুজোর সময়। ঘুরে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষে তা দেখবেন উমা।
আরও পড়ুন: দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণে রাজি নয় বেশির ভাগ পুজো