—ফাইল চিত্র।
এত দিন যে কোনও বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভা ও দমকল দফতরের ‘গাফিলতির’ দিকে আঙুল তুলতেন বিরোধীরা। অগ্নি-সুরক্ষাবিধি না-মানা সত্ত্বেও কী ভাবে শহরের অনেক বাজারে রমরমিয়ে ব্যবসা চলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন তাঁরা। কিন্তু বাগড়ি মার্কেট-কাণ্ডের পরে কার্যত সেই প্রশ্ন তুললেন খোদ পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। প্রসঙ্গত, ওই দুই দফতরেরই দায়িত্বে রয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়।
বিষয়টি আরও আলাদা মাত্রা পেয়েছে সোমবার, যেখানে মন্ত্রিগোষ্ঠী বাগড়ি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে গড়া অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ফিরহাদকে দিয়েছে। এ দিন বাগড়ি মার্কেট পরিদর্শনেও যান ফিরহাদ। সেখানে তিনি বিক্ষোভের মুখে পড়েন। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও আগুন না-নেভা এবং দমকলের দেরিতে আসার অভিযোগ নিয়ে বিক্ষোভ দেখান ব্যবসায়ীরা। বিক্ষোভ সামলাতে মন্ত্রী বলেন, ‘‘দাঁড়ান নাটক করবেন না।’’ পরে তিনি বলেন, ‘‘শহরের কোন কোন মার্কেটের অবস্থা বাগড়ি মার্কেটের মতো হয়ে রয়েছে, তা পুরসভা ও দমকল উভয়েরই দেখা উচিত। শুধু এক দিন পরিদর্শন করে দমকল দফতরের অগ্নি সুরক্ষার ছাড়পত্র দিয়ে দিলে হবে না।’’
আর এ নিয়ে শোভনবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না। কারণ, আমি নিজে শুনিনি। তবে কী পরিস্থিতিতে কী করা হয়েছিল, তা সকলেই জানেন।’’
নবান্ন সূত্রের খবর, পুরকমিশনার খলিল আহমেদ এবং নগরোন্নয়নসচিব সুব্রত গুপ্তকে নিয়ে ফিরহাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে অনুসন্ধান করবেন। অনুসন্ধানের আওতায় থাকবে বেআইনি বাড়ি, জবরদখল এবং ঢোকা-বেরনোর পথ চিহ্নিত করা। পরবর্তী পর্যায়ে পুলিশ এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের তদন্ত করবে। তার পরে আবাসন-ইঞ্জিনিয়ারেরা গিয়ে বাগড়ি মার্কেটের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন। কারণ, সেটিকে ইতিমধ্যেই বিপজ্জনক বলা হচ্ছে। অথচ পুরসভা ও দমকল, এই দফতরের দায়িত্বে মেয়র থাকা সত্ত্বেও কেন শোভন এ দায়িত্ব পাননি, তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। এটা তাঁর অধীনস্থ দফতরগুলির ব্যর্থতা কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ বার মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার আগে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নিজেরই সরে যাওয়া উচিত।’’ বাম কাউন্সিলর চয়ন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি যে, মেয়র নিজের দফতরের কাজ দেখভাল করছেন না। এই ঘটনায় আবারও তা প্রমাণিত।’’
অথচ প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ এ-ও জানাচ্ছেন, যাতে ‘অন্তর্বর্তী তথ্য’ আদানপ্রদানে কোনও রকম ধোঁয়াশা না থাকে, সে কারণেই দমকল ও পুরসভার দায়িত্ব এক জনের হাতেই ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তার পরেও তো ফাঁক থেকে যাচ্ছে। শহরে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডেও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রের এ-ও খবর, কোনও ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্সের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে দমকলের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। ওই দফতরের কাছ থেকে ‘এনওসি’ পেলে তবেই স্থায়ী ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়। না হলে শুধু ‘প্রভিশনাল লাইসেন্স’ দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে দমকল দফতর কেন কড়াকড়ি করছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নগরোন্নয়ন দফতরের কর্তাদের একাংশ।
আরও পড়ুন: বাড়ি ভেঙে পড়বে না তো? বাগড়ি মার্কেটে চিন্তা এখন সেটাই
এ বিষয়ে বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘পুরমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট, পুরসভা ও দমকল বিভাগের গাফিলতি রয়েছে। তা হলে শুধু বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে মন্ত্রীগোষ্ঠী এফআইআরের সিদ্ধান্ত নিল কেন? বাকিদের বেলা কেন হবে না?’’ বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী থাকলে ঘটনা ঘুরিয়ে দিতেন। তিনি এখানে নেই আর সেই সময়ে তাঁর মন্ত্রীরা দোষারোপের খেলায় নেমেছেন।’’
“এত দাহ্য পদার্থ ওখানে রেখেছে! বাথরুমটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি করবেন যে, দমকল পর্যন্ত যাওয়ার জায়গা নেই? একে ব্যবসা বলে না। এটা গুন্ডামি। আমি ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে নই। কিন্তু এটা বরদাস্ত করা যায় না।” —মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
নবান্ন সূত্রের খবর, এ দিন বাগড়ি মার্কেট নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ছ’তলা ওই বাড়ির ভিতর ততটা প্রশস্ত ছিল না। এমন একটি ব্যবসায়ী কেন্দ্রে আদর্শ পরিস্থিতিতে আগুন নেভানোর যে ব্যবস্থা থাকা উচিত, তা যথাযথ ভাবে ছিল না। এ দিনের বৈঠকে সে সংক্রান্ত একাধিক প্রশ্ন উঠেছে। যেমন ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া যে ব্যবসাগুলি চলছে, তারা এত দিন ধরে কী ভাবে নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, ইনকাম ট্যাক্স এবং জিএসটি প্রক্রিয়া চালালেও সে বিষয়টি কী ভাবে পুরসভা এবং দমকল বিভাগের নজর এড়িয়ে গেল? আবার এ-ও প্রশ্ন উঠেছে যে, কেন প্রতি শনিবারই মার্কেটে আগুন লাগছে? প্রসঙ্গত, এ দিনের বৈঠকে ছিলেন না সেচসচিব তথা সচিবদের নিয়ে গঠিত কমিটির প্রধান নবীন প্রকাশ এবং স্বাস্থ্যসচিব রাজীব সিন্হা। ওই বৈঠক থেকে এই সব কিছুই জানানো হয়েছে জার্মানি সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মন্ত্রিসভা তথা সংশ্লিষ্ট কমিটির এক প্রবীণ সদস্যের কথায়, ‘‘কমিটি তৈরি হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামলানোর জন্য। কমিটি স্থায়ী কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’’ পরশু, বৃহস্পতিবার ফের ওই কমিটি বৈঠকে বসবে।