শোকে বিহ্বল মা বৃহস্পতিদেবী। (ইনসেটে) প্রীতি নস্কর। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
নৃশংস ভাবে খুন করা হল চার বছরের এক শিশুকন্যাকে। দু’দিন নিখোঁজ থাকার পরে বুধবার তার বস্তাবন্দি দেহ উদ্ধার হয়। দেখা যায়, হাতের দু’টি আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছে। উপড়ে নেওয়া হয়েছে চোখ। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, শ্বাসরোধ করে তাকে খুন করা হয়েছে। নিউ টাউন থানার মহিষগোঠ শিবতলা এলাকার এই ঘটনায় শিশুটির পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিবেশী এক দম্পতিকে আটক করেছে পুলিশ। জেরা করা হচ্ছে ওই শিশুকন্যার অন্যান্য আত্মীয়দেরও।
পুলিশ জানায়, মহালয়ার সকাল থেকে নিখোঁজ ছিল প্রীতি নস্কর (৪)। দু’দিন পরে বুধবার সকালে তার নিজের কাকা শঙ্কর নস্করের বাড়ির চিলেকোঠা থেকে উদ্ধার হয় ওই শিশুর বস্তাবন্দি মৃতদেহ। প্রীতির বাবা রঞ্জিত নস্কর জানিয়েছেন, গত সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার পর থেকে মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সর্বত্র তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়। আশপাশের বাড়িগুলিতেও মেয়ের খোঁজ করেন তাঁরা। রঞ্জিতবাবুর বাড়ির উল্টো দিকেই তাঁর ভাই শঙ্করবাবুর বাড়ি। সেখানেও খোঁজ করা হয়। কোথাওই খবর মেলেনি প্রীতির। পরে থানায় অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি মঙ্গলবার গোটা এলাকায় মাইকে প্রচারও করা হয় বলে জানান প্রীতির পিসেমশাই সুমন মান্না।
পরিবারের লোকজন জানান, এ দিন সকালে শঙ্করবাবুর বাড়িতে বসে সকলে মিলে চা খাচ্ছিলেন। সেই সময়ে একটা পচা গন্ধ নাকে আসে। সেই গন্ধ অনুসরণ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখা যায়, চিলেকোঠার ঘরে একটা প্লাস্টিকের চালের বস্তা থেকেই ওই গন্ধ আসছে। বস্তা খুলতেই বেরিয়ে আসে প্রীতির পচনশীল দেহ। গোটা শরীর ফুলে গিয়েছে। একটি চোখ ওপড়ানো। ডান হাতের তর্জনী ও অনামিকা আঙুল দু’টি কাটা।
চিলেকোঠার পাশ দিয়েই উঠে গিয়েছে একটি নারকেল গাছ। নস্কর পরিবারের সন্দেহ, যাঁরা প্রীতিকে অপহরণ করেছিল, ওই নারকেল গাছ বেয়েই তারা বস্তাবন্দি দেহ রেখে গিয়েছে চিলেকোঠায়। পুলিশ অবশ্য সেই দাবিকে দিনের শেষে উড়িয়ে দিয়েছে। কেননা, চার বছরের একটি শিশুর দেহ বস্তায় ভরে তা নিয়ে নারকেল গাছে ওঠা খুব একটা সহজ কাজ নয় বলেই মনে করছে পুলিশ। বরং পুলিশের সন্দেহ, প্রীতিকে খুন করা হয়েছে তার কাকার বাড়িতেই।
প্রীতির খুনের পিছনে পারিবারিক গোলমাল কিংবা অন্য কোনও সমস্যার বিষয়টিকেই প্রাথমিক ভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে পুলিশ। পরিবারের ঘনিষ্ঠরাই খুনের পিছনে রয়েছে বলেই সন্দেহ পুলিশের। বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই বলেন, ‘‘বাচ্চাটির মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে তার কাকার বাড়িতে। ফলত পরিবারের লোকজনকে সন্দেহের তালিকায় তো রাখা হবেই। কারণ কাকার বাড়িটিতে প্রবেশ ও প্রস্থানের দরজা একটিই। সেই বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে মৃতদেহ পৌঁছলো কী ভাবে, সেটাই রহস্য।’’ পুলিশ মনে করছে, খুন করার পরে মৃতদেহ সরাতে না পেরেই চিলেকোঠার ঘরে সেটি রেখে দেওয়া হয়েছিল। আততায়ীরা চেয়েছিল, সুযোগ বুঝে মৃতদেহ সরিয়ে ফেলবে। কিন্তু দুর্গন্ধ বেরিয়ে যাওয়ায় তারা সেই সুযোগ পায়নি।
এই বাড়ির চিলেকোঠা থেকে পাওয়া গিয়েছে প্রীতির দেহ। ছবি: শৌভিক দে।
রহস্যের কিনারা করতে সন্ধ্যায় প্রীতির কাকা শঙ্করবাবু, কাকিমা কবিতাদেবী ও জ্যাঠা বিশ্বজিতবাবুকে জেরা করতে নিউ টাউন থানায় ডেকে পাঠায় পুলিশ। প্রীতির দেহ উদ্ধারের পর থেকেই পরিবারের সকলের দফায় দফায় জেরা চলেছে। সেই জেরা হয়েছে শঙ্করবাবুর বাড়িতেই। তিনতলা বাড়িটিতে ছ’টি ঘর রয়েছে। ঘরের একতলা এবং তিনতলায় ভাড়া দেওয়া। দোতলায় শঙ্করবাবু থাকেন।
যদিও প্রীতির মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে নস্কর পরিবারের শরিকী জায়গায় ভাড়াটে এক দম্পতিকে আটক করে পুলিশ। প্রীতির মা বৃহস্পতিদেবীর অভিযোগ, শ্যামল কুশারী ও মধুমিতা কুশারী নামে ওই দম্পতি নিঃসন্তান। তাঁদের মুরগির ব্যবসা রয়েছে। তাঁরা সন্তানলাভের আশায় প্রীতিকে বলি দিয়েছেন। বৃহস্পতিদেবী বলেন, ‘‘আমার মেয়ে কারও কাছে যেত না। শুধু ওই মহিলার (মধুমিতা) কাছে যেত। ওকে মিষ্টি খাইয়ে বশ করেছিল ওই মহিলা।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মহালয়ার দিন ওই মহিলা পুজোর বাজার করতে বেরিয়ে যায়। তার পরপরই আমার মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। ওঁর স্বামী বারবার আমাদের বলেন, এক তান্ত্রিকের সঙ্গে উনি যোগাযোগ করেছেন। মেয়ে বাড়ির আশপাশেই কোথাও রয়েছে। ওরা তুকতাক করে আমার মেয়েকে মেরে ফেলেছে।’’
প্রীতির মায়ের অভিযোগকে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না পুলিশ। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘কুসংস্কার, তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাস করে মানুষ অনেক সময়ে অনেক নৃশংস অপরাধ করে থাকে। ফলত বৃহস্পতিদেবীর অভিযোগকে গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে। তার জন্যই ওই দম্পতিকে জেরা করা হচ্ছে।’’
রঞ্জিতবাবু ও বৃহস্পতিদেবীর দুই মেয়ে জ্যোতি ও প্রীতি। প্রীতি ছোট। মেয়ের শোকে এ দিন বৃহস্পতিদেবী কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘‘এই বছর ছোট মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছিলাম।’’
ঘটনার রহস্যভেদ করতে নিউ টাউন থানা আর কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ যৌথভাবে কাজ করছে। সকালে প্রীতির দেহ উদ্ধারের পরে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ কুকুর। দুপুরে ফরেন্সিক বিভাগ গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে।
মেয়ের জ্যাঠা বিশ্বজিত্ নস্করের দাবি, যে দিন প্রীতি নিখোঁজ হয়, সে দিন রাত আড়াইটে নাগাদ তিনি একটি ফোন পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে ফোন করে বলা হয়, কী রে বিশ্বজিত্, ভাইঝি তো নিখোঁজ! এ বার কী করবি?’’ পুলিশ সেই ফোন কলটি খতিয়ে দেখছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জানতে পেরেছে, ফোনটি উত্তর কলকাতার দিক থেকে করা হয়েছিল।
নস্কর পরিবারের মধ্যে একেবারেই নিম্নবিত্ত রঞ্জিতবাবু। দাদা বিশ্বজিৎবাবুর মুদির দোকানে কাজ করতেন। দাদা ও ভাই মিলে তাঁকে একটি অটো কিনে দেন। সেটি ভাড়ায় দিয়ে আর দোকানে কাজ করেই সংসার চলে রঞ্জিতবাবুর।
ময়না-তদন্তের পরে বুধবার রাতেই প্রীতির দেহ কবর দেওয়া হয় বলে জানায় তার পরিবার।
পড়ুন : ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ স্পৃহা আর অপরাধ মনস্কতার যোগফল, বলছেন মনোবিদরা