অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালত থেকে জেলে ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন এসএসসি-র নিয়োগ-দুর্নীতি কাণ্ডে ইডি-র হাতে ধৃত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। মহিলা কারারক্ষীদের একাংশ জানিয়েছেন, সে দিন সহবন্দিদের সামনে ছলছলে চোখে অর্পিতা একটা কথাই বার বার বলছিলেন, ‘‘এ জীবনে আমার হয়তো আর জেলমুক্তি হবে না। আজ তো আইনজীবী আমার জামিনের আবেদনও করলেন না। ওঁরা বলছেন, এখন জামিন হওয়া অসম্ভব। আবেদন করেও লাভ নেই।’’ কারারক্ষীদের একাংশের মতে, দিনদিনই মানসিক ভাবে আরও বেশি রকম বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে অর্পিতাকে।
আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারে রয়েছে প্রায় ৩০০ বর্গফুটের একটি হলঘর। আর তাতেই ১৯ জন বন্দির সঙ্গে রাখা হয়েছে অর্পিতাকে। সেই ঘরের মধ্যেই একটি উঁচু দেওয়ালের ও-পারে রয়েছে চারটি শৌচালয় আর স্নানের ব্যবস্থা।
জেল সূত্রের খবর, কারাগারে অর্পিতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সেই কারণে ২৪ ঘণ্টাই পালা করে এক জন মহিলা কারারক্ষী অর্পিতার সঙ্গে থাকেন। সকালে-বিকেলে হলঘরের বাইরে বড় বারান্দায় একটু হাঁটেন অর্পিতা। নিরাপত্তার কারণে অন্য বন্দিদের মতো তাঁকে ওয়ার্ডের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। শুধুমাত্র আইনজীবীরা এলে তাঁকে অফিসঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, অর্পিতার সমস্ত খাবার ও জল পরীক্ষা করে তবেই তাঁকে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, দিনরাত তাঁর উপরে নজরদারির নির্দেশও হয়েছে। কারা দফতর সূত্রের খবর, নিরাপত্তার কারণেই অর্পিতাকে একা কোনও সেলে রাখা হয়নি। একাধিক বন্দির সঙ্গে একটি ঘরে রাখা হয়েছে।
ওই ৩০০ বর্গফুটের ঘরেই দিনে ও রাতে মাটিতে কম্বল বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা। এমন ভ্যাপসা গরমেও ওই ঘরে সিলিং ফ্যান রয়েছে মাত্র তিনটি। সেই হাওয়াও ঠিক মতো পান না সকলে। অর্পিতাকে দেখাশোনায় নিযুক্ত এক মহিলা কারারক্ষীর কথায়, ‘‘টিভি থেকে যা জেনেছি, টালিগঞ্জের ডায়মন্ড সিটিতে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ১৬৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে থাকতেন অর্পিতা। এখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন না একদম। সব সময়ে একটা অস্থিরতার মধ্যে থাকছেন। আমাদের ও অন্য বন্দিদের অর্পিতা বলেছেন, পার্থবাবু নাকি তাঁকে প্রথম দিকে মেয়ের মতো দেখতেন। পরে বলেন, তুমি আমার বান্ধবী।’’ জেলে বসে পার্থকেই সারা দিন দোষারোপ করছেন অর্পিতা, জানালেন ওই কারারক্ষী।
অর্পিতার সহবন্দিরা কেউ খুনের আসামি, কেউ বা মাদক পাচারে অভিযুক্ত। তাঁরা প্রায়ই অর্পিতার সামনে পার্থের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে টিপ্পনী করছেন। কিন্তু অর্পিতার সঙ্গে সারা ক্ষণ এক জন করে রক্ষী থাকায় কেউ খুব বেশি বাড়াবাড়ি করতে পারছেন না। কারা দফতর সূত্রের খবর, জেলে আসার পর থেকে দুপুরের ও রাতের খাবারের মান নিয়ে একাধিক বার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্পিতা। কিন্তু আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, জেলের সাধারণ খাবারই তাঁকে দেওয়া হচ্ছে। সকালের জলখাবারে মাখন-টোস্ট ও চা নিয়ে তেমন আপত্তি নেই অর্পিতার। কিন্তু দুপুরের ও রাতের খাবার দেখলেই চোখে জল এসে পড়ছে তাঁর।
অর্পিতার আইনজীবী নীলাদ্রিশেখর ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘অর্পিতার বন্ধু, পরিচিত বা পরিজনেরা কেউই যোগাযোগ করছেন না। প্রথম দিকে তা-ও কয়েক জন যোগাযোগ রাখছিলেন। কিন্তু তাঁরাও এখন যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছেন।’’ কারারক্ষীদের একাংশ জানালেন, সেলের ভিতরে প্রায়ই কান্নাকাটি করছেন অর্পিতা। মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। সহবন্দিদের কেউই তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল নন। তাই অর্পিতা সকলের মধ্যে থেকেও অসম্ভব একা এবং অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর এক আইনজীবী বললেন, ‘‘অর্পিতার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি মেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য জেলে আসতে রাজি হননি।’’
অর্পিতার নিরাপত্তার কথা ভেবেই একাধিক বন্দির সঙ্গে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলে যে শৌচালয় ব্যবহার করেন, অর্পিতাও সেখানেই যান। কিন্তু শৌচালয়ের পরিচ্ছন্নতা নিয়েও একাধিক বার অভিযোগ করেছেন তিনি। জেল কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘‘শৌচালয় পরিচ্ছন্নই রাখা হয়। তবে যে ধরনের শৌচালয়ে যেতে অর্পিতা অভ্যস্ত, জেলে তার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাই এই সমস্যার সমাধান করার কোনও উপায় আমাদের হাতে নেই।’’