প্রত্নতাত্ত্বিক সেই নিদর্শন। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
কলকাতার উপনগরী নিউ টাউনে কি এক-দু’হাজার বছর আগেও কোনও জনবসতি ছিল? অথবা, এখনকার পূর্ব কলকাতা জলাভূমিও কি সুদূর অতীতে ছিল মানুষের বাসভূমি? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপকেরা সম্প্রতি নিউ টাউনের কোচপুকুর এলাকার একটি ঢিবি থেকে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়ার পরে এই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কোচপুকুরের ওই ঢিবি থেকে বেশ কিছু মৃৎপাত্রের টুকরো পাওয়া গিয়েছে। প্রাথমিক পরীক্ষার পরে জানা গিয়েছে, আদি মধ্যযুগ বা এক হাজার থেকে দু’হাজার বছর আগের যে সব মৃৎপাত্রের নিদর্শন এর আগে তাঁরা পেয়েছেন, সেগুলির সঙ্গে কোচপুকুরের প্রত্নসামগ্রীর
যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তাঁরা।
নিউ টাউনের কোচপুকুরের ওই ঢিবি এক সময়ে বিদ্যাধরী নদীর খুব কাছেই ছিল বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “বিদ্যাধরীর তীরবর্তী চন্দ্রকেতুগড় থেকে এমন প্রত্নসামগ্রী আমরা আগেও পেয়েছি। চন্দ্রকেতুগড় কোচপুকুর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। সেই সময়ে সম্ভবত বিদ্যাধরী কোচপুকুরের কাছ দিয়েই বয়ে যেত। ফলে কোচপুকুরের ঢিবির প্রত্নসামগ্রী এক-দু’হাজার
বছর আগের কোনও জনবসতির হতেই পারে।” কৌশিকবাবু জানান, এর আগে দমদমের ক্লাইভ হাউসেও এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। তাই দমদম, রাজারহাট, নিউ টাউন এবং ভাঙড়ের মতো এলাকা নিয়ে বড়সড় কোনও জনপদ আগে ছিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। কৌশিকবাবু বলেন, “এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কোচপুকুরের ওই ঢিবির আশপাশে আরও খনন করা দরকার। উদ্ধার হওয়া প্রত্নসামগ্রী ঠিক কতটা প্রাচীন, তা জানতে পরীক্ষাগারে সেগুলির ‘রেডিয়োকার্বন ডেটিং’ করা প্রয়োজন।”
কোচপুকুরের আদি বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ওই এলাকা সম্পর্কে পুরনো দিনের অনেক গল্প তাঁরা শুনেছেন। তবে তার কতটা সত্যি, তা জানা নেই। কোচপুকুরে বহু প্রজন্ম ধরে রয়েছে দেওয়ান পদবিধারী কয়েকটি পরিবার। ওই সমস্ত পরিবারের সদস্যদের দাবি, প্রবীণদের কাছে তাঁরা শুনেছেন, বহু আগে ওই ঢিবির কাছ দিয়েই বয়ে যেত বিদ্যাধরী। সেই নদীপথে নাকি বড় বড় বাণিজ্যতরীও আসত। কয়েকটি বাণিজ্যতরীর ডুবে যাওয়ার গল্পও শুনেছেন তাঁরা। এমনকি, ওই এলাকায় বিদ্যাধরীর তলদেশ থেকে এমন কিছু জলযানের অংশও নাকি পাওয়া গিয়েছিল। কোচপুকুরের প্রত্নসামগ্রী এখন রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে। চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পূর্ণ বসুচৌধুরী বললেন, “প্রাচীন ঘর-বাড়ি ভেঙে গেলে মাটির সঙ্গে মিশে ঢিবির আকার ধারণ করে। কোচপুকুরের ওই ঢিবিতে আরও কিছু নিদর্শন থাকতেই পারে। সেখানে বেশ কিছু পুরনো গাছপালার নিদর্শনও মিলেছে।”
দমদম, রাজারহাট, সল্টলেকের ইতিহাস চর্চায় রত ‘দেশকাল’ নামে একটি সংস্থার সদস্য শ্যামল ঘোষ ও মৌমিতা সাহা জানালেন, আজকের সল্টলেক, যা আগে ‘লবণ হ্রদ’ নামে পরিচিত ছিল, সেখানকার ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়েই কোচপুকুরের ওই ঢিবির সন্ধান পান তাঁরা। ঢিবিটি দেখতে গিয়েই প্রত্নসামগ্রীগুলি পাওয়া যায়। তার পরেই তাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শ্যামলবাবু বলেন, “বিদ্যাধরীর তীরবর্তী এলাকায় প্রাচীন সামগ্রী আগেও পেয়েছি। এখন আবার কোচপুকুরের ঢিবিতে এই সব মৃৎপাত্রের টুকরো পেলাম। যা দেখে আমাদেরও মনে হয়েছে, এক সময়ে দমদম, রাজারহাট,
নিউ টাউন ও ভাঙড় মিলিয়ে নদীমাতৃক কোনও জনপদ ছিল। কে বলতে পারে, আজ নিউ টাউনে নতুন যে বসতি বা মেট্রো রেল তৈরি হচ্ছে, সেখানেই এক সময়ে ছিল জমজমাট কোনও জনপদ। মাটির গর্ভে যা চাপা পড়ে রয়েছে এখনও।”