দিশা গঙ্গোপাধ্যায়
টিভি সিরিয়ালের পরিচিত মুখ তিনি। বয়স মাত্র ২৩। বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজের ফ্ল্যাট থেকেই উদ্ধার হল দিশা গঙ্গোপাধ্যায়ের নিথর ঝুলন্ত দেহ। অস্বাভাবিক এই মৃত্যুর কিনারা হওয়ার আগেই চাঞ্চল্য ছড়াল মৃতার বান্ধবী, এক সহ-অভিনেত্রীকে ঘিরে। হাওড়ায় রেললাইনের পাশে উদভ্রান্ত অবস্থায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছিল তাঁকে। সাধারণ মানুষই ওই যুবতীকে আটকান। পরে তাঁকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তরুণীর পরিবার জানিয়েছে, দিশার সঙ্গে তাঁদের মেয়ের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। দু’জনে একই সিরিয়ালে অভিনয় করতেন। প্রাথমিক ভাবে পুলিশেরও অনুমান, বান্ধবীর মৃত্যুতেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ওই তরুণী।
দিশা বেহালার পর্ণশ্রী এলাকায় মায়ের সঙ্গে থাকতেন। পুলিশ সূত্রের খবর, দিশার বাবা দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজ করেন। বিনোদন জগত সূত্রের খবর, দিশাও এর আগে বিদেশে থাকতেন। বছর পাঁচেক আগে তিনি পড়াশোনা করতে কলকাতায় আসেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই সিরিয়ালের কাজ শুরু করেন। তবে কয়েক মাস আগে দিশার বাবা তাঁর স্ত্রীকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যান। তার পর থেকে দিশা ওই ফ্ল্যাটে একাই ছিলেন। দিশার ওই বান্ধবীও মাঝেমধ্যে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। এ দিন প্রাথমিক তদন্তে দিশার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তাঁর ঘর থেকে কোনও সুইসাইড নোট উদ্ধার করা হয়নি। এই মৃত্যুর পিছনে এখনও কোনও অপরাধের ইঙ্গিতও মেলেনি বলে পুলিশের দাবি।
তা হলে দিশার এমন ভাবে মৃত্যু হল কেন?
পুলিশ সূত্রের খবর, দিশার এক বন্ধু এ দিন প্রথমে থানায় খবর দিয়েছিলেন। এ দিন সকালে ওই যুবকই বনমালী নস্কর রোডের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ঝুলন্ত দেহটি দেখেন। ওই বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, বুধবার রাতে ইডেনে তাঁর সঙ্গে নাইট রাইডার্সের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন দিশা। খেলা শেষে ওই বন্ধুর বেলেঘাটার বাড়িতে গিয়ে রাতের খাওয়াদাওয়া সারেন। এর পর ওই বন্ধুই দিশাকে তাঁর পর্ণশ্রীর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেন। গভীর রাত পর্যন্ত দু’জনের কথাও হয়েছিল। পুলিশ জানায়, ওই যুবক সকালে ফের দিশাকে ফোন করেন। কিন্তু দিশা ফোন না তোলায় সন্দেহ হয় তাঁর। তার পরেই ওই যুবক দিশার ফ্ল্যাটে যান। ওই যুবক পুলিশকে জানিয়েছেন, দীর্ঘ ক্ষণ ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও ঘরের ভিতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন। তখনই তাঁর নজরে পড়ে, ওড়নার ফাঁস লাগিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে দিশার দেহ। এর পরে তিনি পুলিশে খবর দেন। দেহ উদ্ধারের পর দিশাকে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। দিশার বাবা-মাকে খবর দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে এ দিন বিকেলে হাওড়ায় রেললাইনের পাশে সন্দেহজনক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এক তরুণীকে। তাঁর বাড়ি বরাহনগরে। দিশার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলে পরিচিত তিনি। পুলিশের সূত্র বলছে, তরুণী যে ভাবে রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাতে মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারত। তাঁকে আটকের পরেই কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। রাতে তরুণীর পরিবার জানায়, ওই তরুণী মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর শরীরে কিছু আঘাত রয়েছে। তাঁকে একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছে। কী ভাবে ওই তরুণী হাওড়ায় পৌঁছলেন, তা বুঝতে পারছে না তাঁর পরিবার। তবে তাঁরা জানিয়েছেন, টেলি সিরিয়ালের এক অভিনেতাই ফোন করে বাড়িতে খবর দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই মেয়ের হাওড়ায় উদ্ধার হওয়ার কথা জানতে পারেন তাঁরা।
একই দিনে এক অভিনেত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ও তাঁর বান্ধবীর রেললাইনের পাশে ঘোরাঘুরি করা— দু’টি ঘটনা পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয় বলেই অনুমান মনোবিদদের। এক জন মানুষ আর এক জনের উপরে মানসিক ভাবে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা। ফলে এ ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে কোনও গভীরতর সম্পর্ক ছিল কি না, সম্পর্কে কোনও বাধা বা সমস্যা এসেছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে তাঁদের মত। তবে মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের কথায়, ‘‘এ ধরনের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক ভাবে হয়। ভেবেচিন্তে কাজ করলে দিশার বান্ধবী হয়তো এমনটা করতেন না।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, ঘরের ভিতর থেকে দিশার মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সেটি ‘লক’ করা রয়েছে। তদন্তকারীরা সেই ‘লক’ খোলার পরেই বেশ কিছু তথ্য মিলবে বলে পুলিশ মনে করছে। আত্মীয়-বন্ধুদের পাশাপাশি প্রয়োজনে বিনোদন জগতে দিশার পরিচিতদের সঙ্গেও কথা বলা হবে বলে তদন্তকারীরা জানান। ‘বউ কথা কও’ সিরিয়ালে নায়িকার বান্ধবীর ভূমিকায় অভিনয় করে দিশা প্রথম পরিচিতি পান। এর পরে ‘কনকাঞ্জলি’, ‘মৌচাক’, ‘অদ্বিতীয়া’-র মতো জনপ্রিয় সিরিয়ালেও কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে দিশা ‘তুমি আসবে বলে’ সিরিয়ালে অবসাদগ্রস্ত পুত্রবধূর ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন।