এক ফালি ছাদের আশা, অসহায় তৃতীয় স্বর

একুশ শতকের ভারতের নাগরিক-মানচিত্র জুড়ে নানা স্তরে ছেয়ে আছে এই নিজস্ব পরিসর দখলের লড়াই। পেশায় হাসপাতালের ওটি টেকনিশিয়ান, রূপান্তরকামী এক নারী যেমন এ বার নিজের ঘর ভাড়া পাওয়ার লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন।  

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৯ ০২:৪৪
Share:

নিজের ঘর। নিজস্ব পরিসর। বিশ শতকের গোড়ায় মেয়েদের কিংবা স্বাধীন স্বকীয় নারী সাহিত্যিকের নিজের ঘর বা নিজের ঠাঁই খোঁজার লড়াই নিয়ে ‘রুম অব মাই ওন’ বইটি লিখেছিলেন ভার্জিনিয়া উল্‌ফ।

Advertisement

একুশ শতকের ভারতের নাগরিক-মানচিত্র জুড়ে নানা স্তরে ছেয়ে আছে এই নিজস্ব পরিসর দখলের লড়াই। পেশায় হাসপাতালের ওটি টেকনিশিয়ান, রূপান্তরকামী এক নারী যেমন এ বার নিজের ঘর ভাড়া পাওয়ার লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন।

শহর কলকাতায় নিজের ঘর বা ফ্ল্যাট খুঁজে পেতে কোনও মুসলিম পরিবার কিংবা লিভ-ইন দম্পতি কিংবা একলা নারী বাধার মুখে পড়েছেন এমন নমুনার আকছার খোঁজ মেলে। বৈষম্যের শিকার মুখটা পাল্টে পাল্টে যায়। রূপান্তরকামী নারী-পুরুষ তথা তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের ক্ষেত্রেও একই ভাবে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আদতে মালদহের বাসিন্দা জিয়া দাস যেমন খাস দক্ষিণ কলকাতার উপান্তে তাঁর কর্মস্থল হাসপাতালের কাছে ঘর ভাড়া পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘গড়িয়া, মুকুন্দপুর, কসবা— কত জায়গাতেই দেখলাম। তালিম নিয়ে চাকরি করছি ছ’মাস হতে চলল, এখনও থাকার একটা জায়গা খুঁজে পেলাম না।’’ জিয়ার অভিজ্ঞতা, ‘‘গড়িয়ার এক বাড়িওয়ালার সোর্স ফোন করে ডেকেছিলেন। আমাকে দেখেই নিজের ফোন বন্ধ কর প্রায় পালিয়ে গেলেন। কী আর বলি!’’ জিয়া এখন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে রয়েছেন। কিন্তু নিজের মতো থাকার জায়গার সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

একদা রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার ডেভলপমেন্ট বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিংহের কথায়, ‘‘কোনও কোনও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মতোই তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদেরও ঘর পাওয়া একটা বিরাট সমস্যা এ শহরে।’’ রঞ্জিতা নিজে পারিবারিক ফ্ল্যাটে থাকেন। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক ভাল নয় বা যাঁরা দূর থেকে কলকাতায় আসেন, তাঁদের ঘোর মুশকিল বলেই জানান তিনি। রঞ্জিতা জানান, ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের অন্দরে তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের জন্য হোম ইত্যাদি গড়ার কথা হয়েছে। তবে বিষয়টি তখন দানা বাঁধেনি। সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা অবশ্য মনে করেন, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের আলাদা হোম তৈরি করলেও তাঁদের সেই আলাদা করেই রাখা হবে, আখেরে সমাজে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর কাজটা এগোবে না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতাতেও অনেকের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। সেটা বদলানো জরুরি। তা হলেই জিয়াদের ঘর ভাড়া পেতে সমস্যা হবে না।’’

জিয়ার জীবন জুড়েই সামাজিক মূলস্রোতে জায়গা করার লড়াই। বারবার বাড়ি ছেড়েছেন। ফিরেও এসেছেন। কৈশোরে নিজের মতো বাঁচার টানে একদা বিহারে ‘মেয়েলি ছেলে’দের দলে লন্ডা নাচের আসরে যোগ দিয়েছিলেন। সেই নাচের দর্শক পুরুষদের নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে যান। হিজড়েদের দলেও যোগ দিয়েছেন এর পরে। ট্রেনে হিজড়েদের সঙ্গে ভিক্ষা করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে জিয়ার।

সেখান থেকেই বিএ পাশ করা, হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীর কাজের তালিম গ্রহণ। এর পরেও কাজের সুযোগ পেতে দেরি হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে জিয়া ধৈর্য ধরেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘হয়তো আমি তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত বলে লোকে এখনও হিজড়েদের দলে ভিক্ষাবৃত্তি করব ভাবেন। আমিও যে একটা সম্মানজনক পেশায় রুটিরুজি জোগাড় করতে পারি, তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। আর পাঁচ জনের মতো আমার মাথার উপরে ছাদের দরকারটা তাই সহজে বোঝেন না ওঁরা।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement