জল, বিদ্যুতের দাবিতে টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে বিক্ষোভ। ছবি- সোমনাথ মন্ডল।
আমপানের (প্রকৃত উচ্চারণ উম পুন) ছোবলে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে কলকাতা। স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার আপাতত কোনও চিহ্ন নেই। উল্টে জল, বিদ্যুতের দাবিতে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রাত পর্যন্ত চলছে বিক্ষোভ, অবরোধ। হুগলির উত্তরপাড়াতে অবরোধ ঘিরে অশান্তি বাধে। পুলিশ লাঠি চালিয়েছে বলেও অভিযোগ।
বুধবার সন্ধ্যায় প্রবল গতিতে শহরের বুক দিয়ে বয়ে যায় অতি-ঘূর্ণিঝড় আমপান। সেই ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার। সেই ক্ষত এখনও স্পষ্ট শহরের বুকে। বিভিন্ন রাস্তায় পড়ে রয়েছে বড় বড় গাছ। পড়ে রয়েছে ট্রাফিক সিগন্যাল পোস্ট। ফলে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গত দু’দিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। পৌঁছচ্ছে না জলও। শহর জুড়ে চলছে হাহাকার। পুরসভা, পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে শহরকে পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু শহরবাসীদের অভিযোগ, গত দু’দিন হয়ে গেলেও তাঁরা না পাচ্ছেন জল, না পাচ্ছেন আলো। সেই সঙ্গে মরার উপর খাঁড়ার ঘা, মোবাইলে সংযোগের দুরবস্থা। যোগাযোগ করা যাচ্ছে না কারও সঙ্গে। বিভিন্ন জায়গায় আটকে থাকা পরিজন কোথায় রয়েছেন, কেমন রয়েছেন, তা জানা যাচ্ছে না, দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে।
ইএম বাইপাস, বেহালা থেকে টালিগঞ্জ, গড়িয়া থেকে যাদবপুর ও উত্তর কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় একই ছবি ফুটে উঠছে। এ দিন জল এবং বিদ্যুতের দাবিতে টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডও অবরোধ করেন সেখানকার বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, অবিলম্বে রাস্তায় পড়ে থাকা গাছ সরাতে হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হবে। এবং জলের ব্যবস্থা করতে হবে। যত ক্ষণ পর্যন্ত এই তিন দাবি না মিটবে, তাঁরা অবরোধ চালাবেন। বুধবার দুপুর থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায় গড়িয়ার মহামায়াতলা এলাকায়। বেহালায় পুলিশের গাড়ি ঘরেও বিক্ষোভ দেখান সেখানকার মানুষ। রাজডাঙাতেও একই ভাবে জল ও বিদ্যুতের দাবিতে সরব হয়েছেন বাসিন্দারা।
হরিশ মুখার্জি রোডে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তায় ভেঙে পড়া গাছ সরিয়েছেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসক বোর্ডের চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, “বেহালা, টালিগঞ্জ সহ কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় গাছ পড়েছে। বিদ্যুত সংযোগও কোথাও কোথাও নেই। দুই দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।” কলকাতা পুরসভা, পুলিশের পাশাপাশি বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরাও রাস্তা থেকে গাছ সরানোর কাজে হাত লাগিয়েছেন।
প্রশাসন এবং পুরসভার নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে বিক্ষোভ বি টি রোডে। —নিজস্ব চিত্র।
একই ছবি বেহালার শকুন্তলা পার্কেও। সেখানে বিশাল আকারের গাছ পড়ে গিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে রাস্তাকে। গাড়ি চলাচল স্তব্ধ। দু’দিন হয়ে গেল পুরসভার কোনও কর্মী সেই গাছ সরানোর উদ্যোগ দেখাননি বলে অভিযোগ। বেহালার বিভিন্ন এলাকা এখনও জলমগ্ন। বেহালা ট্রাম ডিপোর সামনে, ব্যাঙ্কের সামনে পড়ে রয়েছে গাছ। মানুষ ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলবেন, সে উপায়ও নেই। তারাতলা ফ্লাইওভারের উপর এখনও পড়ে রয়েছে লাইট পোস্ট। বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ না থাকায় পাম্পের সাহায্যে পুরসভার জল রিজার্ভারে তোলা যাচ্ছে না। তার ফলে জলের সংকট তৈরি হয়েছে। রাস্তায় কল অধিকাংশই ভাঙা। ফলে সেখান থেকেও জল পাওয়া যাচ্ছে না। যে দু-একটি টিউবওয়েল রয়েছে। সেখানে প্রচুর মানুষের লাইন পড়ছে।
বেহালার শকুন্তলা পার্কে পড়ে রয়েছে গাছ। ছবি- সোমনাথ মন্ডল
যাদবপুরের বিভিন্ন জায়গায়, বিজয়গড়, বাঘাযতীনেও একই অবস্থা। শহর যেন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় গাছ পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। ভবানীপুরের রমেশ মিত্র মোড, গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জি রোড, যোগেশ মিত্র রোড গাছ পড়ে রাস্তা আটকে রয়েছে। একইভাবে শরৎ বোস রোড মিন্টো পার্কের কাছে রাস্তা আটকে যাওয়ায় দক্ষিণ কলকাতা থেকে ধর্মতলাগামী বিভিন্ন রাস্তায় যানজট তৈরি হয়েছে। এজেসি বোস রোডের উপর রিপন স্ট্রিট, জোড়া গির্জার কাছে পর পর ছ’টি গাছ পড়ে রাস্তার এক দিক বন্ধ। এসএন ব্যানার্জি রোডে এখনও পড়ে রয়েছে বিশালাকার গাছ। তা এখনও সরানো যায়নি। যার জেরে সেখান দিয়ে চলাচল করতে পারছে না কোনও যানবাহন। ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের কাছে নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটে পড়ে থাকা বিশালাকার গাছ সরানোর কাজ করছে কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকবিলা বাহিনী। পুরসভার সূত্রে জানা যাচ্ছে, শহরের বিভিন্ন জায়গা গাছ পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে তা সরানোর চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাস্তায় গাছ সরিয়ে এক দিক ফাঁকা করা হয়েছে। সেখান দিয়েই কোনও মতে চলছে গাড়ি। কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী নেমেছে পথে। প্রশাসনের আশ্বাস, এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে তাঁরা সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছেন। শহরবাসীর কাছেও তাঁদের আবেদন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য কিছুটা ধৈর্য ধরতে হবে।
শুধু কলকাতাই নয়, বিদ্যুৎ না থাকায় ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা তেঁতুলতলায় গড়িয়া মেন রোড় অবরোধ করেন। পরে পুলিশ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ বাহিনী। তাঁরা অবস্থানকারীদের বোঝাচ্ছেন কলকাতার সর্বত্র একই অবস্থা। হুগলির উত্তরপাড়াতে বিক্ষোভের মুখে পড়ে পুলিশ বাহিনী। পরে লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে তারা।
বি টি রোডেও এ দিন একাধিক জায়গায় অবরোধ হয়েছে। বেলঘরিয়া রথতলার মোড়ে এ দিন সকালে অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এলাকায় বিদ্যুৎ নেই এবং বিভিন্ন রাস্তায় জল জমে রয়েছে। প্রশাসন এবং পুরসভা নিষ্ক্রিয় বলে অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ শুরু হয়। রথতলা মোড়ে কামারহাটি পুরসভার সামনেই অবরোধ চলতে থাকে। পরে ডানলপেও অবরোধ হয় বিদ্যুৎ এবং জমা জল সরানোর দাবিতেই।
আরও পড়ুন: ঝড়ের দাপটে ধাক্কা খাচ্ছে করোনা-চিকিৎসা
আরও পড়ুন: শহর তছনছ করে ১৯টি প্রাণ নিল আমপান