সৌরভ-অমিত সাক্ষাৎকে আদৌ ‘রাজনৈতিক’ বলে ব্যাখ্যা করছে না বিজেপি।
সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চললে শুক্রবার রাতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে নৈশভোজে যাচ্ছেন অমিত শাহ। তাঁর সঙ্গে যাওয়ার কথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তেরও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজ্য সফরের আগেই বিষয়টি ঠিক হয়েছিল বলে বৃহস্পতিবার বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে দলের অধিকাংশের কাছে বিষয়টি এখনও জানানো হয়নি। শুধু রাজ্য স্তরের কিছু শীর্ষনেতা ওই সফরের কথা জানেন। তবে তাঁরাও প্রকাশ্যে ওই সফর নিয়ে কিছু বলতে চাইছেন না। এখন দেখার, সৌরভের বাড়িতে অমিতের নৈশভোজ নিয়ে রাজ্যের শাসক তৃণমূল বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে কী প্রতিক্রিয়া আসে বা আদৌ আসে কি না।
বৃহস্পতিবার রাজ্য বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ অমিত, শুভেন্দু এবং স্বপনের যাওয়ার কথা সৌরভের বেহালার বাড়িতে। ঘটনাচক্রে, তার আগে অমিত থাকবেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে। ঘটনাচক্রেই যে অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করবেন সৌরভের পত্নী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়। এবং যে অনুষ্ঠানে রাজ্যের কোনও প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না-জানানো নিয়ে ইতিমধ্যেই এক দফা বিতর্ক তৈরি হয়েছে (যদিও রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হওয়ার সুবাদে রাজ্যপাল খাতায়কলমে ‘রাজ্যের প্রতিনিধি’ হলেও তিনি যে প্রকৃতপক্ষে তা নন, তা রাজ্যেও একটি শিশুও সম্ভবত জানে)। বিজেপি সূত্রের খবর, প্রথমে ঠিক ছিল, শুধু অমিতই সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজে যাবেন। পুরো বিষয়টি দু’তরফের মধ্যে সমণ্বয় করছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন। যিনি এক বছর আগে রাজ্যে বিধানসভা ভোটে লড়েছিলেন এবং হেরে গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, অমিতের সঙ্গেই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুও সৌরভের বাড়িতে যাবেন। যাওয়ার কথা স্বপনেরও।
এমনিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে সৌরভের সম্পর্ক খুবই ভাল। কিছুদিন আগেও সৌরভ নবান্নে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। ঘটনাচক্রে, অমিতের সঙ্গে যাঁর সৌরভের বাড়িতে যাওয়ার কথা, সেই শুভেন্দু গত বিধানসভা ভোটে অতি সামান্য ভোটের ব্যবধানে হলেও নন্দীগ্রামে মমতাকে হারিয়েছিলেন। তার পর থেকে শুভেন্দু বিরোধী দলনেতার রাজনীতি অনুযায়ী লাগাতার নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে মমতাকে আক্রমণ করে থাকেন। মমতা ভবানীপুর উপনির্বাচনে জেতার পরেও তিনি কড়া কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। তবে বিজেপি সূত্রে সৌরভের বাড়িতে অমিত-সফরকে আদৌ ‘রাজনৈতিক’ বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে না। তাদের বক্তব্য, এটি নেহাতই ‘সৌজন্য সফর’। অমিতের পুত্র জয় শাহ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে সৌরভের ডেপুটি। সেই সূত্রে আগে আহমেদাবাদে অমিতের বাসভবনে সৌরভকে একাধিক বার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি তা রক্ষাও করেছেন। ফলে সহকর্মীর বাবা বাড়িতে আসতে চাইলে বোর্ড সভাপতি সৌরভের পক্ষে সৌজন্যবশতই তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই বাবার নাম অমিত শাহ এবং তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে তো আরওই নয়।
বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, অমিত নিজেই সৌরভের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেই মতোই বার্তা পৌঁছয় বেহালায়। তার পর থেকেই নৈশভোজের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তবে প্রত্যাশিত ভাবেই এর মধ্যে উভয়পক্ষই ‘রাজনীতি’ আনতে চাইছে না। কিন্তু রাজনীতির অনুষঙ্গ এসেই পড়ছে। কারণ, রাজ্যে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি যে সৌরভকে ‘মুখ্যমন্ত্রীর মুখ’ হিসেবে বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অনুরোধ করেছিল, তা কারওরই অজানা নয়। কিন্তু সাতপাঁচ ভেবে সৌরভ সেই প্রস্তাবে শেষপর্যন্ত সাড়া দেননি। তবে তার ফলে বিজেপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কোনও অবনতি হয়নি। আবার মমতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বন্ধনও অটুট থেকেছে। বস্তুত, সৌরভের ঘনিষ্ঠদের একাংশ একান্ত আলোচনায় এ কথা বলতে দ্বিধা করেন না যে, ক্রিকেটার সৌরভের ক্রিকেট প্রশাসক হওয়ার পিছনে মমতা এবং অমিত— দু’জনেরই অবদান রয়েছে। মমতা যেমন সৌরভকে সিএবির সভাপতি পদে দেখতে চেয়েছিলেন, তেমনই অমিতের হস্তক্ষেপেই একেবারে শেষ মুহূর্তে কর্ণাটকের ব্রিজেশ পটেলকে দৌড় থেকে সরিয়ে দিয়ে সৌরভ বিসিসিআই সভাপতি পদে বসেন। যদিও কোনও পক্ষই প্রকাশ্যে এ কথা স্বীকার করে না। তবে ভারতে ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি যে বহু বছর ধরেই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, তা সকলেরই জানা।
আবার অন্যদিকে, অমিত-মমতা সম্পর্ক বরাবরই যথেষ্ট ‘মধুর’। ফলে সৌরভের বাড়িতে অমিতের সফর নিয়ে মমতা কী বলেন, তা নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। তবে রাজনীতির কারবারিদের একাংশের দাবি, সৌরভ সম্ভবত আগেই মমতাকে অমিতের নৈশভোজ প্রসঙ্গে জানিয়ে রেখেছেন। যদিও এই খবরের কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেনি।
ঘটনাক্রম বলছে, ‘দাদা’ ভারতের প্রধান ক্রিকেট প্রশাসক হওয়ার পরেই তাঁকে বিজেপিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দিয়ে ‘দিদি’র বিরুদ্ধে ‘মুখ’ হিসেবে তুলে ধরার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সৌরভ প্রস্তাবটি যে প্রাথমিক ভাবে একেবারে নাকচ করে দিয়েছিলেন, তা-ও নয়। তবে তিনি তাঁর বহু হিতৈষীর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের পরামর্শও নেন। সৌরভের ঘনিষ্ঠদের দাবি, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই তাঁকে বিজেপির হয়ে প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিতে বারণই করেছিলেন। ভোটের ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে, তাঁরা সৌরভকে ভুল পরামর্শ দেননি। তবে যাঁরা সৌরভের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন, তাঁরা এখনও বলেন, ‘সৌরভ ফ্যাক্টর’ না-থাকার ফলেই বিজেপিকে ১০০-রও অনেক কম আসনে থেমে যেতে হয়েছিল। বিপক্ষে সৌরভ থাকলে ভোটের ফলাফল তৃণমূলের পক্ষে এতটা ‘একপেশে’ হত না।
এক বছর আগে ভোটে বিপুল বিপর্যয়ের পর বৃহস্পতিবার প্রথম অমিত বাংলায় এলেন। দু’দিন ধরে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গে ঠাসা কর্মসূচি রয়েছে তাঁর। কিন্তু তার মধ্যেই তিনি সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজে যাওয়ার সূচি স্থির করে রেখেছেন বলেই রাজ্য বিজেপি সূত্রের খবর। মহারাজের বেহালার দরবারে অমিত-সফর ঘিরে কালীঘাটে কী হয়, সেটা নিয়েই ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়েছে।