সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
আশির দশকে এইচআইভি-র সংক্রমণ রুখতে বছরভর চেন্নাইয়ের জেলে বন্দি রাখা হয়েছিল যৌনকর্মীদের। তাঁরা জানতেই পারেননি, কী তাঁদের ‘অপরাধ’। দরজা বন্ধ করে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিহারের জনকপুরের কাছে সীতামঢ়ীর যৌনপল্লিতে। পুড়ে মৃত্যু হয় বহু যৌনকর্মী ও তাঁদের শিশুসন্তানের। গুজরাতের গান্ধীনগরে ক্লাস করতে আসা যৌনকর্মীদের তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সামনেই কুকথা শুনিয়ে দেন আচমকা পরিদর্শনে আসা সরকারি আধিকারিকেরা। ফলে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় সেই ক্লাস।
এ রাজ্যের বাইরে যৌনকর্মীদের বর্তমান অবস্থা এমনই। সেখানে তাঁরা এতটাই কোণঠাসা যে, বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মাঝেমধ্যে। তাই যৌনকর্মীদের নিয়ে শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক রায়কে হাতিয়ার করে কী ভাবে এই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব, সেই দিশা দেখাতে রবিবার শহরে এক আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল ‘অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অব সেক্স ওয়ার্কার্স’ (এআইএনএসডব্লিউ)। তাতে এ রাজ্য ছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন ওড়িশা, গুজরাত, কর্নাটক, রাজস্থান-সহ একাধিক রাজ্যের যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানেরা।
সোনাগাছির মতো ভিন্ রাজ্যের যৌনকর্মীদের এক ছাতার তলায় আনতে একদা এআইএনএসডব্লিউ তৈরি করেছিলেন ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি’র কর্ণধার, প্রয়াত স্মরজিৎ জানা। ২০১১ সালে যাত্রা শুরু হয় সেই সংগঠনের। তার প্রেসিডেন্ট পুতুল সিংহ এবং কোর কমিটির সদস্য ও দুর্বারের মেন্টর ভারতী দে এক সুরে বলছেন, ‘‘ভিন্ রাজ্যে যৌনকর্মীরা এতটাই একঘরে যে, তাঁদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই। তাই তাঁদের অধিকারের জন্য সারা দেশে লড়াই করতে চাইছি আমরা।’’
শ্রমিকের অধিকারের দাবি বহু বছর ধরেই করে আসছে সোনাগাছি। সম্প্রতি শীর্ষ আদালত সাফ জানিয়েছে, কোনও যৌনকর্মী সাবালিকা হলে এবং স্বেচ্ছায় এই পেশায় থাকলে তাঁর উপরে হামলা করা যাবে না। তাঁর নাম-পরিচয় গোপন রাখতে হবে। যৌনকর্মীকে ধর্ষণ, হেনস্থার অভিযোগও দায়ের করতে হবে পুলিশকে। চেন্নাইয়ে যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা শামলা নটরাজনের কথায়, ‘‘চেন্নাইয়ে গত দু’বছরে তিন বার যৌনকর্মীদের উপরে সমীক্ষা হয়েছে। তাতে ৯৮ শতাংশ মেয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় এই পেশায় এসেছেন। এ রাজ্যেও সেই রকম সমীক্ষা করা উচিত।’’ আলোচনাসভায় যৌনকর্মীরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের সন্তানদের হোমে রাখা কতটা নিরাপদ? ইউটিউবারদের উপদ্রবে কী ভাবে পরিচয় গোপন রাখবেন তাঁরা? গ্রেফতারির ভয়ে যৌনপল্লিতে কেউ ঘর ভাড়া না দিলে ফের অত্যাচার বাড়বে না তো?
তবে বাস্তব বলছে, শীর্ষ আদালতের রায়ের পরেও এই প্রান্তজনেদের উপরে অত্যাচারের কাহিনি বদলায়নি। রাজস্থানের যৌনকর্মী সুলতানা বেগমের কথায়, ‘‘আমাদের ওখানে যৌনকর্মীদের লুকিয়ে কাজ করতে হয়। পুলিশ যখন-তখন হামলা চালায়। সংবাদমাধ্যমের লোকেরাও আমাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখেন না। যেন কী বিশাল অপরাধ করেছি! সোনাগাছির মতো জায়গা আমাদের কাছে স্বপ্ন।’’ আচমকা পুলিশি হামলা, কয়েক বছরের জন্য গ্রেফতার করে রিমান্ড হোমে ঢুকিয়ে দেওয়া, পরিবার-আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়া, সন্তানের জন্মের শংসাপত্র দেখাতে না পারলে তাকেও হোমে পুরে দেওয়া— এ সব অন্যত্র ‘জলভাত’। সেখানে সাহায্য তো দূর, কথাই বলতে চান না প্রশাসনিক নেতা-মন্ত্রীরা। আলোচনাসভায় উপস্থিত রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘এ রাজ্যের বাইরে যৌনকর্মীদের পরিস্থিতি গুরুতর। পাচার করে কাউকে এই পেশায় আনা হচ্ছে কি না, তা দেখা প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু তা করতে গিয়ে যেন যৌনকর্মীদের উপরে জুলুম না হয়। কিছু রাজ্যের সরকার যৌনকর্মীদের প্রতি সহমর্মী নন। তাই এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গকেই দিশা দেখাতে হবে।’’