বাতাসের বিষেই এখন নাজেহাল এ দেশের মানুষ! সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি সমীক্ষা থেকে পাওয়া গিয়েছে এমনই রিপোর্ট। আমেরিকার হেল্থ এফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, বায়ুদূষণের জেরে ২০১৫ সালে ভারতে অন্তত ১১ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যা কি না বায়ুদূষণের রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত চিনের সমতুল। এই পরিস্থিতিতে এ শহরের স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, দেশের মহানগরীগুলির মধ্যে দূষণের নিরিখে কলকাতা একেবারে প্রথম সারিতে। দিল্লির পরেই।
কলকাতায় যে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতি বছরের ছ’মাস বায়ুর দূষণ মাত্রাতিরিক্ত থাকে, তা মেনে নিয়েছেন এ রাজ্যের পরিবেশ দফতরের কর্তারাও। তাই বায়ুদূষণের কুফলের নিরিখেও কলকাতার স্থান তালিকার উপরে থাকবে বলেই মনে করছেন পরিবেশকর্মীরা।
বক্ষ ও শ্বাসরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকের অভিজ্ঞতা, গত কয়েক বছর ধরেই কলকাতা শহরে হাঁপানি ও শ্বাসনালীর সংক্রমণে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ুদূষণের অর্থ হাওয়ায় ভাসমান কণা এবং বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। দূষণ বাড়লে যে শ্বাসরোগ এবং ফুসফুসের দুরারোগ্য ব্যাধি বা়ড়তে পারে, এ কথা বহু দিন ধরেই বলা হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বহু গবেষণায় উঠে এসেছে, শুধু ফুসফুস বা শ্বাসনালী নয়, বায়ুদূষণ শরীরের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপরেই প্রভাব ফেলে। তার ফলে ক্যানসার, হৃদ্রোগ, এমনকী অবসাদও দেখা দিতে পারে। বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ পার্থসারথি ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘বায়ুর বিষাক্ত উপাদান ফুসফুস থেকে সারা শরীরেই ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির উপরেও তার প্রভাব পড়ে। শুধু ফুসফুস নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ক্যানসারেও বায়ুদূষণ অনেকাংশে দায়ী। একই কথা প্রযোজ্য হৃদ্রোগের ক্ষেত্রেও।’’
বহু চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর মতে, দূষণে লাগাম টানতে পারলে এই সব রোগের প্রকোপ কমতে পারে। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী মানসরঞ্জন রায় বলেন, ‘‘বায়ুদূষণের মাত্রা যদি ঘনমিটার-পিছু ১০ মাইক্রোগ্রাম কমানো যায়, তা হলে শ্বাসরোগ, হৃদ্রোগের মাত্রা তিন শতাংশ কমতে পারে।’’
এত কিছুর পরেও এ রাজ্যে কিন্তু দূষণের প্রকোপ নিয়ে প্রশাসনের মাথাব্যথা তেমন নেই বলেই পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ। পরিবেশ দফতরের কর্তারাও মেনে নিচ্ছেন, বায়ুদূষণ মহানগরবাসীর স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে কোনও সমীক্ষা তাঁরা করেননি। এক পরিবেশকর্তা জানান, বছর কয়েক আগে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে এক বার এ ধরনের সমীক্ষা করার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু তার কোনও গাইডলাইন মেলেনি। ফলে সেই কাজও আর এগোয়নি। তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও পরিবেশ মন্ত্রক যৌথ ভাবে এই ধরনের সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মারাত্মক দূষণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি যে অবশ্যম্ভাবী, তা মেনে নিচ্ছেন পরিবেশকর্তারা। তা হলে এর হাত থেকে বাঁচার জন্য কোনও উপায় রয়েছে কী?
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘কোন কোন উৎস থেকে মহানগরে কতটা দূষণ ছড়াচ্ছে, সেটা আগে খুঁজে বার করা প্রয়োজন। জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (নিরি)-কে দিয়ে সেই কাজ করানো হচ্ছে। উৎস চিহ্নিত হয়ে গেলে নির্দিষ্ট ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।’’ যদিও পরিবেশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ স্বীকার না করলেও এ শহরে দূষণের মূল উৎস গাড়ির ধোঁয়া। ফলে দূষণে রাশ টানতে হলে ধোঁয়ায় রাশ টানা জরুরি। পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর অনুমিতা রায়চৌধুরীর মতে, গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে উন্নত করলে এই সমস্যা অনেকটাই কমানো সম্ভব। পাশাপাশি, ব্যাটারিচালিত রিকশার মতো পরিবহণ ব্যবস্থাকেও প্রসারিত করতে হবে।
সহনমাত্রা: দিনে গড়ে ১০০ | ধূলিকণার মাত্রা, মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটারে | ১৫ ফেব্রুয়ারির হিসেব | সূত্র: দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ