ঠাকুরপুকুরের সত্যনারায়ণ পল্লির ওই বাড়িতে পুলিশ। নিজস্ব চিত্র
করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন, এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল বছর আশির গোবিন্দ কর্মকারের। কিন্তু করোনা-আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেলে তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রী এবং পঙ্গু ছেলেকে কে দেখবে? টাকাপয়সাও তো নেই, তা হলে ওঁদের চলবে কী করে? এই আশঙ্কা এবং অনিশ্চয়তা থেকেই কি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বৃদ্ধ গোবিন্দবাবু? ঠাকুরপুকুরের সত্যনারায়ণ পল্লির কর্মকার পরিবারের আত্মহত্যার ঘটনার তদন্তে নেমে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ, সুইসাইড নোট এবং মৃত্যুর আগের ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে এমন সম্ভাবনার কথাই প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গোবিন্দবাবু চাকরি করতেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া দু’কামরার বাড়ি। ছেলে দেবাশিস ওরফে বুলা জন্ম থেকেই পঙ্গু। দু’দশক আগে অবসর নেওয়ার পরেও গোবিন্দবাবুই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য। বাড়িতেই ঘড়ি, ছোটখাটো বৈদ্যুতিন যন্ত্র সারাই করে সামান্য রোজগার করতেন। আর তার সঙ্গে ছিল অল্প কিছু জমানো টাকা। কোনও মতে সংসার চলত। তার মধ্যেই লকডাউনের সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তাঁর স্ত্রী সত্তরোর্ধ্ব রুনুদেবী। সপ্তাহ দুয়েক হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলেও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন তিনি।
রোজগার থেকে বাজার—সবটাই করতে হত গোবিন্দবাবুকে। তাঁর প্রতিবেশী তপন চক্রবর্তী মঙ্গলবার বলেন, ‘‘রবিবার সকালে বাজারে গিয়েছিলেন গোবিন্দবাবু। সেখানেই মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে যান। বাজারের লোকজন প্রাথমিক শুশ্রূষা করে বাড়ি পৌঁছে দেন। কিন্তু বাড়ি ফেরার পরে ফের পড়ে গিয়ে সংজ্ঞা হারান তিনি।” প্রতিবেশীদের দাবি, রবিবারের আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন গোবিন্দবাবু। সর্দি-জ্বরের মতো কিছু উপসর্গ ছিল। রবিবার অসুস্থ হওয়ার পর থেকে শ্বাসকষ্টও শুরু হয়। করোনা সন্দেহে রবিবার দুপুরেই ফোন করে সাহায্য চাওয়া হয় ঠাকুরপুকুর থানার পুলিশের কাছে। কিন্তু, তপনবাবু থেকে শুরু করে অন্য প্রতিবেশীদের একরাশ অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। প্রতিবেশীদের এক জন বলেন, ‘‘থানায় ফোন করার পর প্রায় দু’ঘণ্টা বাদে দু’জন পুলিশ কর্মী আসেন। একটি অ্যাম্বুল্যান্সও নিয়ে আসেন তাঁরা। গোবিন্দবাবু-সহ গোটা পরিবারকে তোলা হয় অ্যাম্বুল্যান্সে।” প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, পুলিশকর্মীরা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে যেতে বলেন এবং জানান, তাঁরা হাসপাতালেই যাচ্ছেন ওই তিন জনকে ভর্তি করানোর জন্য।
গোবিন্দ কর্মকারের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলছেন পুলিশ আধিকারিকরা। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: ঠাকুরপুকুরে অনটনে আত্মঘাতী বাবা-মা-ছেলে, মেঝেয় চকে লেখা সুইসাইড নোট
প্রতিবেশীরা হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, ওই দুই পুলিশকর্মী নেই, এমনটাই অভিযোগ। প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও দেখা মেলেনি পুলিশকর্মীর। তপনবাবু বলেন, ‘‘আমরা তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। ওঁরা তিনজনের দেহের তাপমাত্রা মেপে এবং অসুস্থতার বিবরণ শুনে এমআর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। অথচ লিখিত কোনও নথি দিতে চাইলেন না রেফার করার।” এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘আমরা আদৌ তৈরি হয়ে বেরোইনি সে দিন। তাই আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এবং পুলিশকে বলি ওই পরিবারকে হাসপাতালে ভর্তি করার দায়িত্ব নিতে।”
অভিযোগ, কেউ দায়িত্ব নিতে চাননি। ঠাকুরপুকুর থানার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে লালবাজারের কন্ট্রোল রুমেও প্রতিবেশীরা যোগাযোগ করেন বলে জানা গিয়েছে। বহু ক্ষণ পরে সেখান থেকে একটি অ্যাম্বুল্যান্স আসে এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় গোবিন্দবাবুদের। প্রতিবেশীদের দাবি, সেখানেও ভর্তি নেওয়া হয় না। পাঠিয়ে দেওয়া হয় নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও তাঁদের ভর্তি নেওয়া হয়নি। তপনবাবু বলেন, ‘‘রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্স তিন জনকেই বাড়িতে পৌঁছে দেয়।”
এর পর থেকে বাড়িতেই ছিলেন গোবিন্দবাবুরা। এক প্রতিবেশী মহিলা বলেন, ‘‘প্রতিদিন সকালে দরজা খুলে সামনের বারান্দায় এসে বসতেন গোবিন্দবাবু। আজ সকালে দেখি দরজা বন্ধ। ভাবলাম ফের অসুস্থ হয়েছেন। দরজা ধাক্কা দিয়ে বার বার ডাকাডাকির পর কেউ দরজা না খোলায় দরজা ভেঙে ঢুকে দেখা যায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে তিন জনের নিথর দেহ।” খবর দেওয়া হয় পুলিশকে।
ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেহ। নিজস্ব চিত্র
পুলিশ সূত্রে খবর, ঘরে চক দিয়ে লেখা, ‘‘আমরা তিনজনই মৃত।” বিছানার পাশে একটা বাটি। তার পাশে লেখা, ‘‘সাবধান। বিষ।” আর তার পাশেই রয়েছে একটা দোমড়ানো রুলটানা কাগজে লেখা সুইসাইড নোট—
আরও পড়ুন: বাস অমিলে ভোগান্তি চলছেই, বাড়বে কি ভাড়া? সরকারি কমিটিতে জমা পড়ল হিসাব
মঙ্গলবার দেহ উদ্ধার হওয়ার পর ঘটনাস্থলে যান ডিসি (দক্ষিণ পশ্চিম) নীলাঞ্জন বিশ্বাস এবং ঠাকুরপুকুর থানার আধিকারিকরা। তদন্তকারীরা কথা বলেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে। এক তদন্তকারী বলেন, ‘‘গোটা ঘরে অনটনের ছাপ। বিদ্যুতের সংযোগ থাকলেও বিদ্যুতের ব্যবহার প্রায় ছিল না খরচ বাঁচাতে।
সুইসাইড নোট, মৃত্যুর আগে হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে ভোগান্তি, আর্থিক অনিশ্চয়তা— এ সবই খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘সুইসাইড নোট থেকে শুরু করে সমস্ত পারিপার্শ্বিক তথ্য স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, খুব ঠান্ডা মাথায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই পরিবার। আর তার পিছনে গোটা পরিবারের অসুস্থতা এবং অনটন একটা বড় কারণ।”