সম্বল: লকডাউনের শহরে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে খাবার বিলি। শনিবার, টিকিয়াপাড়ায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী
খবর এসেছিল, কয়েক দিন ধরে খাবার পাচ্ছেন না কিছু মানুষ। নেতা-মন্ত্রী থেকে বিভিন্ন সংগঠন সকলের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও তাঁরা অভুক্তই ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিতে নেমেছিলেন বিধাননগর পুর এলাকার বাসিন্দা সাত ‘সেনানী’। জানা যায়, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের আদর্শপল্লির বাসিন্দা সাত জন মানসিক প্রতিবন্ধী ও তাঁদের পরিজনেরা অভুক্ত রয়েছেন। কী ভাবে তাঁদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়েই এখন ব্যস্ত মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ‘জনমানস’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত মহিলা সদস্যেরা।
অবশেষে স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা গিয়েছে বলে জানালেন ওই মহিলা বাহিনীর এক জন, জাপানী দাস। শুধু তা-ই নয়, সদস্যদের কার কাছে আর কত দিনের ওষুধ রয়েছে, সে খোঁজও রাখছেন তাঁরা। কারণ, মানসিক চিকিৎসায় ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হলে তা রোগীদের অনেকটাই পিছিয়ে দেবে। পাশাপাশি, হঠাৎ ঘরে বসে যাওয়ায় বহু পরিবারের আর্থিক কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তৈরি হচ্ছে মানসিক চাপ। জন্মাচ্ছে অবসাদ। সে সব থেকে বার করে আনতেও ওই পুর এলাকার বাসিন্দাদের পাশে রয়েছেন জাপানী ও তাঁর নারী বাহিনী।
বছর ১২ আগে তৎকালীন রাজারহাট-গোপালপুর পুর এলাকার বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন করার কাজ শুরু করেছিল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ‘জনমানস’। এলাকায় মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে সাত জনকে নির্বাচন করা হয়। এত দিন তাঁরা=ই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা বা সংস্থার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করেছেন। মনের অস্থিরতা নিয়ে আসা বাসিন্দাদের সংস্থার অফিসে কাউন্সেলিং করানো হয়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যের এই পরিষেবায় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে ওষুধও হাতে তুলে দেয় নারী বাহিনী।
মানুষের কাছ থেকে সাড়া পেয়ে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গত সাত বছর ধরে কোচবিহার পুর এলাকায় মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রসারের কাজের পরিধি বিস্তার করেছে। ১৪ জন মহিলা সদস্য সামলাচ্ছেন সেই কাজ। তাঁদের পরিবারের সদস্যেরাও যুক্ত হয়েছেন ওই কাজে। এক জরুরি ডাকে তুফানগঞ্জ মানসিক হাসপাতাল থেকে ওষুধ এবং খাদ্যসামগ্রী নিয়ে কোচবিহারের ডোমুকার দিকে যাচ্ছিল সংস্থার একটি গাড়ি। তারই মাঝে ফোনে কথা বলছিলেন রিঙ্কু গুহনিয়োগী। জানালেন, জেলাশাসক ও পুলিশের থেকে অনুমতি নিয়ে জরুরি পাস বার করিয়ে তাঁরা প্রতিদিন গাড়িতে বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যান। কখনও সঙ্গে থাকেন তাঁদের স্বামীরা।
ঠিক এক বছর আগে উত্তর দমদম পুর এলাকায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এখন ১৪ জন মহিলা সামলাচ্ছেন সেই দায়িত্ব। তাঁদেরই এক জন তিলকা মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ইতিমধ্যেই সদস্য-সংখ্যা ১৭০ হয়ে গিয়েছে। তবে মানসিক প্রতিবন্ধী ছাড়া অন্য বিপদগ্রস্ত মানুষেরও খোঁজ রাখছি আমরা। স্থানীয় কাউন্সিলরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত সমস্যা মেটাতে চেষ্টা করছি।’’
লকডাউনেও সংস্থার জরুরি পরিষেবা পেতে যাতে সদস্যদের অসুবিধা না হয়, সে দিকে নজর রাখছেন ‘জনমানস’ প্রকল্পের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শ্রীজা চক্রবর্তী। তিন প্রান্ত থেকে যে কোনও সমস্যার কথা শুনলেই তিনি দ্রুত সমাধান করতে পরামর্শ নিচ্ছেন সংস্থার কাণ্ডারী রত্নাবলী রায়ের সঙ্গে। ওই সংস্থার তরফে রত্নাবলী বললেন, “এই বিপর্যয়েও মানসিক প্রতিবন্ধীদের দেখভাল নিয়ে প্রস্তুত নয় কেন্দ্রীয় সরকার। লকডাউনে সকলের সমস্যা নিয়ে বারবার আলোচনা হলেও এঁদের বিশেষ চাহিদার কথা কেউ বলছেন না। সে জন্যই সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ত্রাণ বিলিতে নামতে হল সংস্থাকে। নির্দেশিকা মেনে এ পর্যন্ত ৪৫০টি পরিবারকে সাহায্য করা হয়েছে। যদিও এটি ক্ষুদ্র প্রয়াস, তবু প্রচেষ্টা বজায় থাকবে।”