চিন্তিত: ছেলে নিবেশকে নিয়ে অপেক্ষায় সন্ধ্যা রাউত। শনিবার, হাওড়া স্টেশনে। নিজস্ব চিত্র।
কেউ বিকল্প উপায়ের খোঁজে ট্র্যাভেল এজেন্টকে ফোন করছেন। কেউ ডিসপ্লে বোর্ডে একের পর এক ট্রেনের নামের পাশে ‘বাতিল’ লেখাটির দিকে চেয়ে রয়েছেন বিভ্রান্তের মতো। কেউ আবার অধৈর্য হয়ে চড় কষাচ্ছেন ক্রন্দনরত কোলের শিশুকে। এর পরে নিজেই শিশুর কান্না থামিয়ে সঙ্গীকে গলা চড়িয়ে বলছেন, ‘‘বাড়ি কি যাওয়া হবে? না কি স্টেশনেই পড়ে থাকব!’’
সেনাবাহিনীতে স্বল্প মেয়াদে নিয়োগের প্রস্তাবিত ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প ঘিরে শুরু হওয়া বিক্ষোভে শনিবারও ভুগতে হল দূরপাল্লার রেলযাত্রীদের। যার জেরে এমনই চেহারা নিয়েছিল হাওড়া, শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশন চত্বর। ট্রেন বাতিল হওয়ার খবর আসা শুরু হতেই উৎকণ্ঠায় ভুগতে শুরু করেন যাত্রীরা। তাঁদের কেউ শুক্রবার থেকে ট্রেন ধরতে স্টেশনেই পড়ে রয়েছেন, কেউ আবার রয়েছেন বৃহস্পতিবার রাত থেকে। এমন দলেরও দেখা মিলল, যাঁদের নিয়ে ট্রেন ছেড়ে গেলেও বিক্ষোভের জেরে তা ফিরে এসেছে। ফলে ফের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা শুরু হয়েছে ওই যাত্রীদের।
এ দিন দুপুরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখা গেল, পর পর ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন যাত্রী-প্রতীক্ষালয়ে, কেউ চাদর পেতে শুয়েছেন মেঝেতেই। অপেক্ষারত যাত্রীদের এক জন, বিজয় রাউত তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যা এবং ছেলে নিবেশকে নিয়ে বালেশ্বর থেকে হাওড়া স্টেশনে এসেছিলেন। এ দিন দুপুরে কুম্ভ এক্সপ্রেস ধরার কথা ছিল। কিন্তু সেটি বাতিল হয়। বিজয় বলেন, ‘‘পটনায় কাজ করি। ছুটিতে বালেশ্বরের বাড়িতে এসেছিলাম। ফিরতে না পারলে বালেশ্বরেই ফিরে যেতে হবে। ছেলে-বৌ নিয়ে কত ক্ষণ স্টেশনে থাকব!’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘শুনলাম, পটনা পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাতেই সব চেয়ে বেশি গোলমাল হচ্ছে। এখন এক বার বাসে করে যাওয়া যাবে কি না, সেই খোঁজ নিতে বেরোব।’’ শুনেই তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সন্ধ্যা বললেন, ‘‘ছেলের মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে। আগে খাবারের ব্যবস্থা করো।’’
একই রকম পরিস্থিতি বারাণসীর সোনকার দম্পতির। তাঁরা জানালেন, স্টেশন চত্বরে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে জ্বর এসে গিয়েছে তাঁদের সন্তানের। ছেলেকে কোলে নিয়ে মেধা সোনকার বললেন, ‘‘ও কিছুই খাচ্ছে না। এ ভাবে কত ক্ষণ কাটাতে পারব, জানি না।’’
কলকাতা স্টেশনেও একই ভোগান্তির ছবি। এ দিন ছাড়ার কথা থাকলেও বাতিল হয়েছে জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস। যার জেরে চরম দুর্ভোগে পড়েন দীনেশ মণ্ডল, কার্তিক মণ্ডলের মতো বহু যাত্রী। জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেসে করেই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা কার্তিকের অম্বালা যাওয়ার কথা ছিল। ট্রেন ধরতে দু’দিন আগেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। কার্তিক বলেন, ‘‘ট্রেন বাতিল হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। কবে কাজে ফিরতে পারব, জানি না।’’ কলকাতা স্টেশন থেকেও একই ভাবে বাতিল করা হয়েছে রাতের পটনা গরিবরথ এক্সপ্রেস, জয়নগর এক্সপ্রেস এবং সীতামঢ়ী এক্সপ্রেস।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকেও এ দিন বাতিল হয়েছে দু’টি দূরপাল্লার ট্রেন। স্ত্রী এবং দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে তারই একটিতে উত্তরপ্রদেশের বালিয়া যাওয়ার কথা ছিল রবি মণ্ডলের। তিনি বললেন, ‘‘মেদিনীপুরে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাসে এসে ধর্মতলায় নেমে ট্যাক্সিতে স্টেশনে এসেছি। দুপুর ১টা নাগাদ রেলের মেসেজে জানলাম, টিকিট কনফার্ম হয়ে গিয়েছে। চার্টও তৈরি। কিন্তু ৩টে নাগাদ শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছনোর পরে ট্রেন বাতিলের মেসেজ এল। আগে জানালে ভোগান্তি হত না।’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘দিল্লিতে গাড়ি চালানোর কাজ করি। মালিক দ্রুত ফিরতে বলেছেন। কাজটাই না এ বার চলে যায়!’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।