এ ভাবেই ফুটপাথে পরিচর্যা হতো অম্লানবাবুর। — নিজস্ব চিত্র
পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনায় নাগরিকদের অমানবিক মুখের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। কিন্তু এ বার মানবিকতার পরিচয় দিয়েও শহরের বাসিন্দারা এক মুমূর্ষুর প্রাণ বাঁচাতে ব্যর্থ হলেন। অভিযোগ, সরকারি ব্যবস্থার লাল ফিতের ফাঁসই এ ক্ষেত্রে ওই বৃদ্ধের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
শুধু মৃত্যু নয়, মারা যাওয়ার পরেও নিস্তার মেলেনি। ময়না-তদন্ত না হয়ে তাঁর দেহ তিন দিন পড়ে থেকেছে হাসপাতালের মর্গে। সম্পর্ক প্রমাণ করতে তাঁর মেয়েকে ৭২ ঘণ্টা ঘুরতে হয়েছে থানা আর হাসপাতালে। তার পরে বাবার দেহ সৎকারের জন্য হাতে পেয়েছেন তিনি।
ঘটনার সূত্রপাত বছরখানেক আগে। বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালের পাশে ফুটপাথে একটি ছাউনির নীচে এক বৃদ্ধকে আশ্রয় নিতে দেখে এগিয়ে এসেছিসেন পাড়ার লোকেরাই। দু’বেলা নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। দিয়েছিলেন বেশ কিছু পোশাকও। এ ভাবেই চলছিল। গত বছরের ৯ নভেম্বর ওই বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন এলাকার লোকেরাই। প্রায় এক মাস সেখানে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন ডাক্তারেরা তাঁর কথাবার্তা এবং আচরণের মধ্যে কিছু অসংলগ্নতা দেখতে পাওয়ায় তাঁকে রেফার করা হয় পাভলভ মানসিক হাসপাতালে।
বিধাননগর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময়েই ওই বৃদ্ধ ভাসা ভাসা ভাবে জানিয়েছিলেন, তাঁর নাম অম্লান দত্ত। বাড়ি উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। সল্টলেকের ওই এলাকার গৃহবধূ শর্মিষ্ঠা মজুমদার এবং তাঁর প্রতিবেশী অমিতাভ সাহা, যাঁরা নিয়মিত তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যেতেন, ওই তথ্যটুকু সম্বল করেই বৃদ্ধের বাড়ি খুঁজে বার করতে উদ্যোগী হন। বৃদ্ধের বর্ণনা অনুযায়ী, শ্যামবাজারের সেই বাড়িতে পৌঁছে জানা যায়, তাঁর দেওয়া সমস্ত তথ্যই ঠিক। জানা যায়, মানসিক সমস্যার জেরে বছর দুয়েক আগে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে থানায় ডায়েরিও করেছিলেন। কিন্তু সন্ধান মেলেনি।
চাকরি সূত্রে মেয়ে আপাতত বিদেশে থাকেন। খবর পাঠানো হয় তাঁর কাছে। দিন কয়েকের মধ্যেই মেয়ে বিদেশ থেকে চলে আসেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে শর্মিষ্ঠাদেবী পাভলভে পৌঁছন। জানা যায়, আচমকা শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ন্যাশনালে পৌঁছন তাঁরা। সেখানে গিয়ে দেখেন, বিপুল রোগীর চাপের মধ্যে শয্যা জোটেনি অম্লানবাবুর। শৌচাগারের সামনের একচিলতে জায়গায় পড়ে রয়েছেন তিনি। বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে দ্রুত তাঁকে ওখান থেকে বার করে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হন তাঁর মেয়ে। কিন্তু ন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, তাঁদের কাছে রোগীর শারীরিক চিকিৎসা চলছে। যতক্ষণ না পাভলভ থেকে তাঁর মানসিক স্থিতিশীলতার সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে, ততক্ষণ তাঁরা রোগীকে ছাড়তে পারবেন না। তা ছাড়া, যেহেতু বিধাননগর থানার মধ্যস্থতায় তিনি পাভলভে ভর্তি হয়েছিলেন, তাই লাগবে সেখানকার অনুমতিও। এর পরে শর্মিষ্ঠাদেবী এবং অম্লানবাবুর মেয়ে কার্যত পিংপং বলের মতো বিধাননগর (উত্তর) থানা, ন্যাশনাল আর পাভলভে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কোথাও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোটেনি। এরই মধ্যে অবস্থার উত্তরোত্তর অবনতি হতে থাকে তাঁর। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনালেই মারা যান ওই বৃদ্ধ।
বাবাকে ফিরে পাননি। বাবার মৃতদেহ হাতে পেতেও কালঘাম ছুটে যায় তাঁর মেয়ের। ময়না-তদন্তের জন্য দেহ পাঠানো হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু প্রয়োজনীয় পুলিশি ছাড়পত্রের জন্য চলতে থাকে টানাপড়েন। বিধাননগর (উত্তর), এন্টালি, বেনিয়াপুকুর থানায় বিস্তর ছোটাছুটি এবং অম্লানবাবু যে সত্যিই তাঁর বাবা, তা প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় গত শনিবার মৃতদেহ হাতে পান তাঁর মেয়ে। নিজের প্রিয়জনকে হারিয়ে, সরকারি লাল ফিতের ফাঁসের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে শহর ছেড়ে নিজের কাজের জায়গায় ফিরছেন তিনি। তাঁর আক্ষেপ, যদি সরকারি হাসপাতালের এমন গয়ংগচ্ছ মনোভাব না থাকত, যদি পাভলভ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে বাবাকে ন্যাশনালের মেল ওয়ার্ডের মেঝে থেকে তুলে এনে অন্য কোথাও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতেন, তা হলে হয়তো পরিণতিটা অন্য রকম হত। আর যদি বাঁচানো না-ও যেত, তা-ও অন্তত শেষ সময়টা নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার সান্ত্বনাটুকু থাকত তাঁর।
কেন এমন টালবাহানা করল পাভলভ? সুপার গণেশ প্রসাদের যুক্তি, ‘‘পাভলভ থেকে রেফার করার পরে উনি টানা কয়েক দিন ন্যাশনালে ভর্তি ছিলেন। সে সময়ে ওঁর মানসিক অবস্থা কী ছিল, তা না জেনে কী ভাবে আমরা সার্টিফিকেট দেব? ১০-১২ দিনে তো মানসিক অবস্থার পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে তো যাবতীয় দায়িত্ব আমাদের উপরে এসে পড়ত।’’
অর্থাৎ, দায় নিজেদের কাঁধে নিতে চায়নি পাভলভ। কিন্তু পাভলভ থেকে কোনও চিকিৎসক ন্যাশনালে গিয়ে অম্লানবাবুকে পরীক্ষা করে কেন সার্টিফিকেট দিলেন না? সে প্রশ্নের কোনও জবাব সুপার দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘সে ব্যাপারে আমাকে আরও খোঁজখবর নিতে হবে।’’
রাস্তায় পড়ে থাকা অম্লানবাবুকে নিয়মিত খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে তাঁর পরিবারের হদিস বার করা, তাঁর মেয়েকে নিয়ে ন্যাশনালে-পাভলভে ক্রমাগত দৌড়োদৌড়ি, সবটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন যিনি, ৫৪ বছরের সেই গৃহবধূ শর্মিষ্ঠা মজুমদার গোটা ঘটনায় হতবাক। তাঁর প্রশ্ন, একটা মানুষ টানা এক বছর রাস্তায় পড়ে ছিলেন। তখন তাঁকে নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু যখন তাঁর আপনজনদের খুঁজে পাওয়া গেল, তখনই সকলে অতি-সক্রিয় হয়ে পড়লেন? ‘‘আমজনতার মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, প্রশাসনের মানবিক মুখ নিয়ে কবে প্রশ্ন উঠবে?’’ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন শর্মিষ্ঠা।