পথ দুর্ঘটনা। — প্রতীকী চিত্র।
কখনও বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হচ্ছে স্কুটারের আরোহী, হেলমেট না পরা শিশুর। কখনও বেপরোয়া গতিতে পথ বিভাজিকা বা সেতুর রেলিংয়ে ধাক্কা মারায় ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে হেলমেটহীন মাথা। সরাসরি একাধিক জনকে পিষে দিয়ে ‘শিক্ষানবিশ’ (লার্নার) স্টিকার লাগানো গাড়ি উঠে যাচ্ছে ফুটপাতে। কখনও আবার কয়েক জনকে পিষে দিয়ে বেপরোয়া গাড়ি ঢুকে যাচ্ছে রাস্তার ধারের দোকানে। একের পর এক এমন ঘটনা ঘটে চললেও কিছুতেই পরিস্থিতির বদল হচ্ছে না কেন? প্রশ্ন উঠছে, পথ-বিধি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা এবং অসচেতন, অপটু হাতে টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স চলে আসার কারণেই কি পর পর ঘটে চলেছে এমন ঘটনা? সরকার ‘ইউনিফর্ম ড্রাইভিং ট্রেনিং মডিউল’ তৈরির ঘোষণা করলেও তা দিনের আলো দেখবে কবে, উঠছে সেই প্রশ্নও।
অনেকেই এমন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করছেন গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নিয়ে চলে আসা দালাল চক্রের রমরমাকে। তাঁদের অভিজ্ঞতা, টাকা দিতে পারলে গাড়ি চালাতে জানার পরীক্ষা না দিলেও চলে। তিন থেকে চার হাজার টাকা খসাতে পারলেই হাতে আসে শিক্ষানবিশ (লার্নার) লাইসেন্স। সে ক্ষেত্রে গাড়ি বা মোটরবাইকের সামনে এবং পিছনে ‘এল’ অক্ষরটি লাগিয়ে দিলেই হল। লার্নার লাইসেন্সধারী চালকদের জন্য পরিবহণ দফতরের অন্যান্য নিয়ম— সূর্যাস্তের পরে তাঁরা গাড়ি বা মোটরবাইক চালাতে পারবেন না, গাড়িতে তাঁদের সঙ্গে স্থায়ী লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক থাকতেই হবে, লার্নার লাইসেন্স পাওয়ার পরে ৩০ দিন সরকারি মোটর ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, লার্নার লাইসেন্স পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে গাড়ি বা মোটরবাইক চালানোর পরীক্ষা দিয়ে তবেই পাকা লাইসেন্স পাওয়া যাবে— এই সব নিয়ম মানারই প্রয়োজন পড়ে না বলে অভিযোগ। সবটাই কোনও এক ‘মোটর ট্রেনিং স্কুল’কে ধরতে পারলেই হয়ে যায় বলেও অভিযোগ।
বেলতলা এলাকার একটি মোটর ট্রেনিং স্কুলের সামনে পৌঁছতেই এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘লাইসেন্স চাই? সব হয়ে যাবে। আড়াই হাজার টাকা লাগবে।’’ কিন্তু গাড়ি তো চালাতে জানা নেই! প্রশিক্ষণও নেওয়া হয়নি। ওই ব্যক্তি বললেন, ‘‘তাতে কী? টাকা একটু বেশি লাগবে। খুশি হয়ে চার হাজার টাকা দিলেই লাইসেন্সের পোর্টালে নাম উঠে যাবে।’’ কিন্তু সরকারি পোর্টালে আবেদন করে লাইসেন্স পাওয়ার খরচ তো এর চেয়ে অনেক কম! আর উত্তর মেলেনি।
এরই মধ্যে সম্প্রতি পরিবহণ মন্ত্রক মোটর ট্রেনিং স্কুল থেকেই লাইসেন্স পেয়ে যাওয়ার নয়া পদ্ধতির কথা ঘোষণা করেছে। এর জেরে ‘রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অফিস’ বা আরটিও-তে যাওয়ার আর প্রয়োজন হবে না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স ঘিরে দালাল চক্রের যে রমরমা চলে, তা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খোদ পরিবহণ দফতরের কর্তারাই। এ ব্যাপারে রাজ্যের তরফে কেন্দ্রকে চিঠি দেওয়ার ভাবনাচিন্তাও করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, পরিবহণ দফতর গত জুন মাসে একটি ‘ইউনিফর্ম ড্রাইভিং ট্রেনিং মডিউল’ তৈরি করার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে। তাতে গাড়ি বা মোটরবাইক চালকদের সচেতনতার উপরে বিশেষ জোর দেওয়া হবে বলে সূত্রের খবর। কিন্তু আর এক মাস পরে বছর শেষ হতে চললেও এই মডিউল কবে চালু হবে, সে নিয়ে কোনও স্পষ্ট দিক-নির্দেশ মিলছে না। পরিবহণ দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘খসড়া তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও তা সরকারের কাছে পাঠানো হয়নি।’’ অর্থাৎ, সরকার সমস্তটা খতিয়ে দেখে অনুমতি দিতে দিতে চলতি বছর পেরিয়ে যাবে বলেই মত ওই পরিবহণ আধিকারিকের।
কী রয়েছে এই ‘ইউনিফর্ম ড্রাইভিং ট্রেনিং মডিউল’-এ? সূত্রের খবর, এতে গাড়ি বা মোটরবাইক চালককে প্রথমে পথ নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি ভিডিয়ো বাধ্যতামূলক ভাবে দেখানো হবে। এর পরে অনলাইনে একটি পরীক্ষা দিতে হবে আবেদনকারীকে। তাতে পাশ করলে হাতেকলমে গাড়ি বা মোটরবাইক চালানোর পরীক্ষা নেওয়া হবে। সেখানে হেলমেট বা সিট বেল্ট পরার প্রকৃত পদ্ধতি, পথবিধি সংক্রান্ত নানা সঙ্কেত জানা আছে কিনা, সে সব দেখা হবে। পরীক্ষা এমন ভাবে নেওয়া হবে, যাতে গাড়ি বা মোটরবাইক চালানোর সব দিক নিয়ে চালকের স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়। এক আরটিও অফিসার বলেন, ‘‘নতুন মডিউলে শুধু পরীক্ষা নেওয়া এবং লাইসেন্স দেওয়াই লক্ষ্য নয়। এই পরীক্ষার পদ্ধতির মাধ্যমে যাতে চালক কিছু শিখতে পারেন, সেটাই মূল ভাবনা।’’ তবে এই নতুন মডিউলে মোটর ট্রেনিং স্কুল থেকেই চালককে লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি রাখা হবে কিনা, তা নিয়েই এখন মূল দ্বন্দ্ব চলছে।