সিমেন্টের বস্তা কেটে এ ভাবেই মেশানো হত মাটি ও পাউডার। নিজস্ব চিত্র
কোনও নির্মাণের ভিত মজবুত হল কি না, তা নির্ভর করে সেটি তৈরিতে ব্যবহৃত সামগ্রীর মানের উপরে। সেই নির্মাণ সামগ্রীর অন্যতম প্রধান হল সিমেন্ট। তাতেই ভেজাল মেশানোর কাজ চলছিল অবাধে। নামী সংস্থার সিমেন্টের বস্তা খুলে অর্ধেক সিমেন্ট বার করে মেশানো হচ্ছিল মাটি ও রাসায়নিক পাউডার। গোপন সূত্রে সেই খবর পৌঁছেছিল হাওড়া সিটি পুলিশের কানে। এর পরেই হাওড়ার শালিমার এলাকার ফোরশোর রোডে অভিযান চালিয়ে বাজেয়াপ্ত করা হল পাঁচশো বস্তা ভেজাল সিমেন্ট। অবৈধ ভাবে গজিয়ে ওঠা যে চারটি গুদামে এই কারবার চলছিল, সিল করে দেওয়া হয়েছে সেগুলিও। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘটকপুকুর থেকে আসা একদল দুষ্কৃতী স্থানীয় কয়েক জন দুষ্কৃতীর সাহায্যে এই কাণ্ড ঘটাচ্ছিল। প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীরা জেনেছেন, এর সঙ্গে যোগ রয়েছে কলকাতায় জাল সিমেন্ট তৈরির মাথা পাপ্পু খানের। গোটা চক্রটিকে ধরার জন্য তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রের খবর, শালিমার স্টেশনের কাছে গঙ্গাতীর বরাবর কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের জমিতে রয়েছে একাধিক গুদাম ও বসতি। বহু বছর আগে ওই এলাকায় ট্রাক টার্মিনাস ও জাহাজ তৈরির কারখানা ঘিরে দুষ্কৃতীদের দাপট থাকলেও ২০১১ সালের পরে তা অনেকটা কমে আসে। কিন্তু অভিযোগ, বছরখানেক আগে গঙ্গাতীরের সৌন্দর্যায়নের পর থেকেই ফের বাড়তে শুরু করে দুষ্কৃতীদের আনাগোনা। সে কারণে বাসিন্দারাই চাঁদা তুলে রাস্তায় সিসি ক্যামেরা বসান।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এর মধ্যেই মাস পাঁচেক আগে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের জমিতে গজিয়ে ওঠে টিন ও টালির চালের কয়েকটি গুদাম। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই গুদামগুলিতে রোজ বিভিন্ন নামী সংস্থার সিমেন্ট আসার পরে বস্তা থেকে অর্ধেক সিমেন্ট বার করে নেওয়া হত। বাকি অংশে মাটি ও রাসায়নিক পাউডার মেশানোর পরে বস্তার মুখ ফের সেলাই করে বিক্রি করা হচ্ছিল বাজারে।
এই খবর আসার পরেই এ দিন দুপুরে বটানিক্যাল গার্ডেন থানার পুলিশবাহিনী ওই গুদামগুলিতে হানা দেয়। সিমেন্টে ভেজাল মেশানোর সময়ে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয় এক শ্রমিককে। বাকিরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শালিমারের ২৫ নম্বর লবণ গুদামের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় গজিয়ে উঠেছে এই চক্র। পরপর চারটি গুদামে কয়েকশো সিমেন্টের বস্তা। পুলিশ জানায়, গুদামগুলি থেকে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার সিমেন্টের নতুন বস্তা। সব বস্তারই একটি কোণ কাটা। ফানেলের মতো একটি জিনিস ওই মুখে ঢুকিয়ে মেশানো হত ভেজাল সিমেন্ট। তার পরে বস্তা ফের সেলাই করে বিক্রির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হত বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থার কাছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির খোঁজে এখন তল্লাশি শুরু করেছেন তদন্তকারীরা।
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সব জেনেও গুদাম মালিকদের ভয়ে তাঁরা এত দিন মুখ বুজে ছিলেন। এক বাসিন্দা ছোটু মিঁয়া বলেন, ‘‘মার খাওয়ার ভয়ে আমরা এত দিন কিছু বলতে পারিনি। চোখের সামনে দেখতাম, দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আসা শ্রমিকেরা সিমেন্টে মাটি ও রাসায়নিক মিশিয়ে ফের বস্তা সেলাই করে দিচ্ছে।’’
বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, সন্ধ্যা হলেই ওই গুদামে যাতায়াত শুরু হয় দুষ্কৃতীদের। গুদামের পাশে একটি ঘরে নিয়মিত বসে মদ-গাঁজা-জুয়ার আসর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সন্ধ্যার পরে মহিলারা রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছেন।
হাওড়ার পুলিশ কমিশনার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ওই গুদামগুলিতে অভিযান চালিয়ে প্রচুর সিমেন্টের বস্তা উদ্ধার হয়েছে। তাতে যে ভেজাল সিমেন্ট মেশানো হত, সেই প্রমাণ মিলেছে। গুদামগুলি সিল করে দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে এক জন। গোটা চক্রটিকে ধরার চেষ্টা চলছে।’’