পাথরপ্রতিমায় বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের পরে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি। —ফাইল চিত্র।
প্রথমে অপরাধ করে গ্রেফতারি, দিন কয়েকের হাজতবাস। তার পরেই জামিন। বেরিয়ে এসে ফের একই অপরাধ, গ্রেফতারি এবং জামিন। আবার একই অপরাধ! রাজ্য জুড়ে বেআইনি বাজি কারবারের সঙ্গে জড়িতদের অনেকের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এমনই জলভাত বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শী থেকে আইনজীবীদের বড় অংশের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার ঢোলাহাটে বাজি বিস্ফোরণে আট জনের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত আগেও একই রকম বেআইনি কাজে গ্রেফতার হওয়ার পরে ছাড়া পেয়েই একই কাজ শুরু করেছিল। তাই অনেকেরই প্রশ্ন, কেন বার বার গ্রেফতারির পরেও হুঁশ হচ্ছে না? তবে কি অপেক্ষাকৃত নরম ধারায় মামলা হওয়ায় তৈরি হচ্ছে না শাস্তির ভয়?
আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কেন এক্সপ্লোসিভস সাবস্ট্যান্স আইনে এমন ক্ষেত্রে মামলা করা হবে না? কোন বৃহত্তর কারণে অপেক্ষাকৃত সহজ ধারা দেওয়া হচ্ছে সেটা ভাবা প্রয়োজন।’’ এর পরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-কে দিয়ে তদন্ত করিয়ে এমন বড় ঘটনায় নেপথ্য কারণ জানা খুবই জরুরি। আর কত মৃত্যুর পরে পুলিশ সক্রিয় হবে?’’ যদিও রাজ্য পুলিশের দাবি, ঢোলাহাটের ঘটনায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (বিএনএস) ২৮৭ (দাহ্য বস্তু সংক্রান্ত আইন), ২৮৮ (বিস্ফোরক নিয়ে অবহেলা), ১০৫ (অনিচ্ছাকৃত ভাবে মৃত্যু ঘটানো), ১১০ (অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা), ১২৫ (অন্যের জীবন বিপন্ন করার মতো কোনও কাজ) এবং ৬১(২) (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) ধারায় মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি মামলা হয়েছে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস আইন ১৯৫০’-এর ২৪ এবং ২৫ নম্বর ধারায়। পুলিশের দাবি, ওয়েস্ট বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস আইনের এই দুই ধারাই বিস্ফোরক পদার্থ সংক্রান্ত। সমস্ত ক্ষেত্রেই কড়া পদক্ষেপের সুযোগ রয়েছে। যদিও আইনজীবীদের বড় অংশেরই বক্তব্য, জামিনযোগ্য ধারায় মামলা করে আদতে কড়া শাস্তির পথ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতেই অনেকে চম্পাহাটির বেগমপুর, হাড়াল, সোলগলিয়া, মহেশতলার নুঙ্গি, পুটখালি, বলরামপুর এবং উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর-সহ সাম্প্রতিক অতীতে যে সমস্ত জায়গায় বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে চাইছেন। তাঁদের দাবি, পর পর মৃত্যুতেও এই সমস্ত এলাকার পরিস্থিতি বদলায়নি। এখনও এই সমস্ত জায়গায় লোকালয়ে দেদার বাজি তৈরি হচ্ছে এবং বসতবাড়িতেই সে সব মজুত রাখা হচ্ছে। এমনকি, পুলিশের নাকের ডগাতেই সমস্তটা চলছে বলে অভিযোগ।
চম্পাহাটির এক বাসিন্দারই অভিযোগ, বড় কিছু না ঘটলে পুলিশ কোনও বাজি কারবারিকেই গ্রেফতার করে না। ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় না। বড় কিছু ঘটলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রেফতারির পরে বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয় না। আদালতে পুলিশ জেল হেফাজতের দাবি জানায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই বলা হয়, বিস্ফোরক তেমন মেলেনি বা ফেটে গিয়েছে। নয়তো বাজি তৈরির সময়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে না বলে তৈরি করা বাজিতে আগুন ধরে গিয়েছে জানিয়ে দুর্ঘটনার মতো করে বিষয়টি দেখানো হয় বলে অভিযোগ। অভিযোগ, যেহেতু বাজি তৈরির উপকরণ তেমন ভাবে বাজেয়াপ্ত করা যায় না এবং আরও জেরার প্রয়োজনের কথা বলে না পুলিশ, তাই জেল হেফাজত হয়ে যায় ধৃতের। দিন কয়েক জেল হেফাজতে কাটিয়েই জামিন পাওয়া যায়। বেরিয়ে এসেই ফের শুরু হয় আগের মতোই বাজির ব্যবসা। অভিযোগ, এই কাজে পরিবারের সদস্যের মৃত্যুতেও মারণ-ব্যবসা বন্ধ হয় না। তা হলে উপায়? লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক অফিসারের মন্তব্য, ‘‘বুঝিয়ে কার্যোদ্ধারের চেষ্টা করারই নির্দেশ দেওয়া থাকে। সেই মতোই সচেতনতা প্রচারের কাজ করা হয়।’’ কিন্তু তাতে কাজের কাজ যে হয় না, ঢোলাহাটের ঘটনা সেটাই আরও এক বার প্রমাণ করল বলে ভুক্তভোগীদের দাবি।