Kolkata News

মঞ্চ যেন মিশে গেছে আমার জীবনেও

আমার শহর, আমার কলকাতা। ১৯৮৮-তে জন্মেছি এই শহরে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর জোড়াসাঁকোয় ‘ড্রামা’ নিয়ে পড়াশোনা শুরু। থিয়েটার শুরু। জীবন দেখা শুরু। আমার বাড়ি টালিগঞ্জের মহাত্মা গাঁধী রোডে।

Advertisement

অঙ্কিতা মাঝি (অভিনেত্রী)

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ ১৫:৩৩
Share:

আমার শহর, আমার কলকাতা। ১৯৮৮-তে জন্মেছি এই শহরে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর জোড়াসাঁকোয় ‘ড্রামা’ নিয়ে পড়াশোনা শুরু। থিয়েটার শুরু। জীবন দেখা শুরু। আমার বাড়ি টালিগঞ্জের মহাত্মা গাঁধী রোডে। আমার বড় হয়ে ওঠা সেখানেই। সেখান থেকেই আমার কলকাতা দেখা শুরু। বানান ভুলে ভরা রাজনৈতিক দলের দেওয়াল লিখনগুলো ঢাকা পড়ে যেত সিনেমার রঙিন পোস্টারে, ভুলগুলো মুছে যেত ওই নায়ক-নায়িকার উজ্জ্বল মুখে। আমার শহর নন্দনকানন, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম, ট্রাম, ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা, নকুড়ের মিষ্টি, গড়ের মাঠ, বইমেলা, মসজিদ-মন্দির-গির্জা, হাওড়া ব্রিজ, পার্কস্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড, দুর্গাপুজো আর অনেক মানুষ।

Advertisement

তবে পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। কলকাতা শহরের রং বদলেছে। হলুদ রঙে মোড়া রাতের কলকাতায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো মূর্তি জীবন্ত হয়ে উঠত। সেই প্রত্যেকটি মূর্তির সাক্ষী, আমার হলুদ কলকাতা কেমন করে চোখের সামনে, ঠিক কবে থেকে, সাদা রক্তসারশূন্য হয়ে উঠল! ট্যাক্সি থেকে ল্যাম্প-পোস্ট... ল্যাম্প-পোস্টে মরে থাকা পোকার জীবাশ্ম ঠিক কখন থেকে সমস্ত আলোয় গ্রহণ লাগাল ঠাহর করতে পারি না সে ভাবে। তবে বুঝতে পারি, ঝাপসা হয়ে গেছে চারপাশ। যে সব গলিগুলোতে দশ বছর আগেও বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলতে দেখা যেত, গাড়ির কালো ধোঁয়ায় তাদের আর দেখি না আমি। তিলের লাঠি, মিষ্টির বড় ভাঁড়, ক্রিসমাসের মিশন মেলা, দশ পয়সার হজমিগুলি, রাস্তার দু’পাশে সবুজ গাছের সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা, আমার প্রিয় সাইকেল, মাঠ, পুকুর, সর্বোপরি গড়ের মাঠের বইমেলা... কলকাতার ঝাড়ুদারদের পোশাক বদলেছে, বদলেছে তাঁদের ঝাটাও; ফলত ভোরের কলকাতার শব্দ পাল্টেছে। মানুষের আতিথেয়তার কায়দা পাল্টেছে। আগে অনায়াসেই সান্ধ্য ভোজনে মুড়ি-চানাচুর অথবা ডিমের ওমলেট আর চায়ে আপ্যায়িত হতেন অতিথিরা। হঠাৎ সেই মুড়িই হয়ে দাঁড়াল স্টেটাস মাপকাঠি। মিষ্টির দামের চাপে, অতিথিদের হাতেও দেখা যায় না ওই বড় হাঁড়ি। কুড়ি পয়সা থেকে হাজার টাকার নোট অচল হয়ে যায়। উন্নয়নের ভিড়ে খাবি খাওয়া মূল্যবোধ, সংস্কৃতি কোথায় যায় কে জানে!

আরও পড়ুন, আলিপুর চিড়িয়াখানায় নতুন অতিথি, আসছে গুজরাতের ‘খাঁটি’ সিংহ

Advertisement

আমার বাবা গণনাট্য করতেন। গান কবিতার পরিবেশ বরাবরই ছিল বাড়িতে। একবার ওদের নাটক দেখতে গিয়েছিলাম আমি। একলব্য-র ভূমিকায় আমার বাবা, সেখানে একলব্য মানে আমার বাবা, নিজের আঙুল কেটে গুরুদক্ষিণা দিচ্ছেন দেখে, আমি খুব কাঁদছিলাম। আসলে ভয় পেয়ে গেছিলাম মারাত্মক। প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে মায়ের আঁচল না দেখে ক্লাস করিনি আমি। সেই আমি, একলব্য-রূপে বাবার কাটা আঙুল দেখে, জীবন আর মঞ্চ গুলিয়ে ফেললাম। সত্যি বলতে তাকে আমি আলাদা করতে পারিনি আজও। বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, জীবন অনেক বড়, থিয়েটারের থেকেও। কিন্তু আমি সে সব বিশ্বাস করা সত্ত্বেও কেমন সব এক করে দিলাম। জীবন-যাপন-থিয়েটার-সম্পর্ক-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিনয়-শক্তি-ভাস্কর-মধুসূদন-শীর্ষেন্দু-শরদিন্দু-নবারুণ-সুনীল-শঙ্খ-সুমন-সব সব এক হয়ে গেল। আর এল হাজারো চরিত্র, কলকাতা শহরের বুকে।

জোড়াসাঁকোয় পড়াকালীন যেই পরিবেশে আমরা বড় হয়েছি, তা আর পাইনি কোথাও। ছেলেমেয়েরা নাচে গানে আবৃত্তিতে মেতে আছে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহড়া চলছে। দ্বারকানাথ, অবন মঞ্চ, ঠাকুর দালান— আমার প্রেম... অনেক পরে বুঝেছিলাম, জীবন আসলে কারও কম নয়। অর্থাৎ চারপাশ দুনিয়াদারি সবটাই অন্য রকম। মুখে বলা আর কাজে করার মাঝে যোজন দূরত্বে হাবুডুবু খাওয়া নৈতিকতা, দর্শন, বোধ, রবীন্দ্র-নজরুল চর্চা, সব আলাদা। তবে অভিনেতার কাজ সবটা গুলিয়ে ফেলা, তার পর নিজের বাইরে বেরিয়ে একটা নতুন চরিত্রায়ন। আর সেই গুলিয়ে যাওয়াতেই একাকার হয়ে যাচ্ছে জীবন, রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, মঞ্চ আর আমি।

আরও পড়ুন, সাত ‘আশ্চর্য’ দেখাতে পারি...

কলকাতার মানুষের ভাষার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, আড্ডাখানায় যে ভাষায় মানুষ কথা বলেন, সেটা আর যাই হোক, সভ্যতা বাহক নয়। একটু স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বললেই আপনি আঁতেল। বাংলা ভাষার প্রয়োগ কি তা হলে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষগুলোর মতোই হয়ে গেল! জীবন পাল্টে দেওয়ার মতো কিছুই তো ঘটছে না; সিনেমা নাটক ছবি গান— কোথায় কী হচ্ছে? সিরিয়াল দেখে মানুষের মন যাচ্ছে বিষিয়ে। নিজের ঘরের মানুষকে সন্দেহ করতে ছাড়ছেন না কেউ। সর্বক্ষণ একে অপরকে সন্দেহ করছেন। ক্ষয় হচ্ছে অবিরাম। বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে কার্যসূত্রে আসা মানুষজন অহরহ গালমন্দ করছেন প্রাণহীন কলকাতাকে, আর এখান থেকে রোজগারের টাকা নিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন নিজের অঞ্চলে। আদতে কলকাতার জন্য ভাবছেন না কেউ!

‘প্রেম এসেছিল নীরবে’— তবে কলকাতায় নয়, কাঁসাই নদীর ধারে। তখন আমার উনিশ বছর বয়স। ভোর চারটের সময় ফোনের ও পার থেকে, দিনের প্রথম ট্রেনের শব্দ পাওয়া যেত। সে প্রথমবার বলেছিল, ‘ভোর বড় সুন্দর, কবিতার থেকেও’। বাড়ির লোকের বাইরে, যে মানুষটা ডাকনামে ডাকলে আমার ভাল লাগত। কলকাতার যাবতীয় রাস্তাঘাট, থিয়েটার হল থেকে রিহার্সাল রুম, সেখান থেকে গানের ক্লাস, জোড়াসাঁকো, নন্দন, বেহালা, বাঁশদ্রোনী, টালিগঞ্জ অশোকনগর, গাছতলা থেকে দিল্লি এনএসডি। মুম্বই থেকে আবার অ্যাকাডেমি— সর্বত্র আমি ওই লম্বা ব্রাক্ষ্মণ ছেলেটার সঙ্গে সংসার করেছি। যদিও সেটা সমাজসিদ্ধ সংসার নয়। আসলে আমাদের আলোচনার পরিধি ছিল বিশাল। অগাধ। পরবর্তী কালে আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমাদের বোধ, নৈতিকতা, মূল্যায়ন, চরিত্রকে বুঝে নেওয়ার খিদে আর অবিরাম খোঁজার চেষ্টা; যা একসঙ্গে বড় হতে হতে দেখা, পড়া, জানা, শেখা, বোঝা হয়েছিল— সেগুলো হারায়নি এখনও। ফলত পৃথিবীর যে প্রান্তেই ওই মানুষটি থাকুন না কেন আমি তাকে জানি। তার পরিধি আমার জানা। ওই শক্ত ভিতে জল দিয়েছি আমি, নিজের হাতে। রবীন্দ্রনাথ থেকে চার্চিল, শেক্সপিয়র থেকে সুমন, চন্দ্রবিন্দু থেকে শীর্ষেন্দু, ইবসেন থেকে ওলবি, হিটলার থেকে গ্রটোস্কি, গোয়েবলস থেকে ঋত্বিক ঘটক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে থিয়েটার, অভিনয় থেকে জীবন বুঝতে শিখিয়েছিল, ওই মানুষটি। এই সব তাই আমার প্রেম... সব শেষে পাঠকদের কাছে অনুরোধ, লেখাটা বিকৃত করবেন না। সত্য কথায় কোনও জটিলতা থাকে না, থাকতে পারে না।

আরও পড়ুন, ‘কম বয়সের’ যুক্তিতে ফাঁসি নয়, মাকে খুনে যাবজ্জীবন ‘ভাল’ ছেলের

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement