Mallika Sarabhai

Mallika Sarabhai: ‘একা মেয়েদের জীবনের চিত্রনাট্য লিখুন তাঁরাই’

গত দু’বছর ধরে চলা অতিমারি-আবহ মহিলাদের তো বটেই, বিশেষত একা মহিলাদের সামনে চলার পথটা কঠিন থেকে কঠিনতর করেছে।

Advertisement

স্বাতী মল্লিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২২ ০৭:১৭
Share:

বলিষ্ঠ: শহরে এক আলোচনাসভায় মল্লিকা সারাভাই। রবিবার। নিজস্ব চিত্র।

দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীনই স্বামীর থেকে বিচ্ছেদ নিয়েছিলেন। প্রথম সন্তানটি তখন সাড়ে পাঁচ বছরের। তার পরে একাই বড় করে তুলেছেন দুই ছেলেমেয়েকে। একা হাতে সামলেছেন সংসার থেকে নাচের জগৎ। নৃত্যের ভাষাতেই সমাজের নানা সমস্যা তুলে ধরেছেন জনমানসে। রাজনীতির জীবন স্বল্প হলেও প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করতে দু’বার ভাবেননি তিনি। স্বাধীন ভাবনা ও মতপ্রকাশের পক্ষে ঋজু মন্তব্য করতেও বার বার দেখা গিয়েছে তাঁকে। রবিবারের কলকাতায় শহুরে একা মেয়েদের নিয়ে এক আলোচনাসভায় এসে বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী মল্লিকা সারাভাই তাই বলছেন, ‘‘সম্পর্ক কিন্তু জৈবিক, আর সেটা কোভিডই আমাদের শিখিয়েছে। তাই একা মেয়েদের বলব, নিজের মধ্যে কতটা এবং কী করার ক্ষমতা আছে, সেটা চিনতে শিখুন। আপনার পরিচয় সমাজকে ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব দেবেন না। কোভিডের এই সময়ে নিজেকে নতুন ভাবে শুরু করার সুযোগটা তাই কাজে লাগান।’’

Advertisement

গত দু’বছর ধরে চলা অতিমারি-আবহ মহিলাদের তো বটেই, বিশেষত একা মহিলাদের সামনে চলার পথটা কঠিন থেকে কঠিনতর করেছে। ২০১১ সালের জনগণনা বলছে, দেশে একা মহিলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত কোটি। কোভিড-কালে বয়স্ক মা-বাবার দেখাশোনা থেকে কর্মস্থলে ছাঁটাইয়ের শঙ্কা, সন্তানের পড়াশোনার গুরুদায়িত্ব— সবই এসে পড়েছে তাঁদের ঘাড়ে। ফলে বাড়ির কাজ ও বাড়ি থেকে কাজ— এই দুইয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে অবিবাহিতা, স্বামীহীনা, একা মা, বিবাহ বিচ্ছেদ নেওয়া মেয়েদের। তাই সেই সময়ে ‘একলা চলো রে’ থিমে বাঁচতে চাওয়া দেশের একা মেয়ে ও মায়েরা যে সত্যিই ততটা একা নন, সেই বার্তা দিতে ফেসবুকে ‘স্টেটাস সিঙ্গল’ নামে পেজ খুলেছিলেন কলকাতার বাসিন্দা শ্রীময়ী কুণ্ডু। দু’বছরে তার সদস্য সংখ্যা ও পরিধি বেড়েছে অনেকটাই। এ দিন সেই একা মহিলা সদস্যদের নিয়েই এক আলোচনাসভায় মল্লিকার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে উঠে এল নাচ থেকে রাজনীতি, মায়ের স্মৃতিচারণা থেকে একক মাতৃত্বের প্রসঙ্গ। সবেতেই অকপট ষাটোর্ধ্ব ওই শিল্পী। সন্তান দত্তক নেওয়া একা মা থেকে শুরু করে ‘হ্যাপিলি সিঙ্গল’ সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা— সকলেই তখন তাঁর গুণমুদ্ধ শ্রোতা।

২০১৬ সালে অশ্রুসজল চোখে নিজের মা, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী মৃণালিনী সারাভাইয়ের মরদেহের সামনে নেচে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন মল্লিকা। সেই ছবি ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। অতিমারি আবহে মাতৃবিয়োগের পরে তাঁর শেষকৃত্য করার অনুমতি না পাওয়া এক মেয়েকে যে ছবি আজও ছুঁয়ে যায়। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই নিমেষে অশ্রুসজল কন্যা মল্লিকার চোখমুখ। বললেন, ‘‘ভালবাসার মানুষটাকে শেষ বিদায় জানানোর ওটাই সবচেয়ে ভাল উপায় ছিল।’’

Advertisement

আবার একা মায়েদের লড়াইটাও সহজে চিনতে পারেন মল্লিকা, কারণ তিনি নিজেও তাঁদেরই প্রতিনিধি। দুই ছেলেমেয়ে ও ছয় পোষ্যের মা মল্লিকা তাই সন্তানের মুখ চেয়ে ব্যর্থ বিয়ে জোর করে টিকিয়ে রাখার বিপক্ষে সওয়াল করেন। বলেন, ‘‘কোনও মেয়েকে দেখলে যদি মনে হয়, ও নিজেকে কী মনে করে! তা হলে সেটাই তো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। আমি তাই নিজের ভিতরের দিকে তাকাতে চাই। ১৯৯৪ সালে নাইজিরিয়ার এক দোকানে গিয়ে স্থানীয় এক মহিলাকে বলেছিলাম, তাঁর মাথার সাজগোজের জন্য তাঁকে কী অপূর্ব দেখতে লাগছে। সে সময়ে ওঁর চোখমুখ দেখে মনে হয়েছিল, গত ২০ বছরে এইটুকু প্রশংসাও তাঁকে কেউ করেননি।’’

আর নাচ? কোভিড-কালে যখন দর্শকের সামনে নৃত্য পরিবেশনের সুযোগ প্রায় বন্ধ, তখনই অনলাইনে নাচের ক্লাস খুলেছেন মল্লিকা। বয়স্ক গৃহবধূ থেকে চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ, দেশের আনাচেকানাচে থেকে সেই ক্লাসে যোগ দিয়েছেন। মল্লিকা জানাচ্ছেন, নাচ শেখানোর জন্য কোভিড সারা বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে তো বটেই, এমনকি অটিজ়ম বা ডাউন সিনড্রোম-যুক্তদের আরও ভাল রাখতে পারে নাচ। লখনউ থেকে যোধপুর, কেরল থেকে চেন্নাইয়ের অনেকেই এই কোভিড পরিস্থিতিতে নাচকে আপন করে নিজেদের ভাল রাখতে পেরেছেন।

তাই কঠিন সময়ে একা মহিলাদের আরও বেশি করে ‘মানুষ’ এবং ‘মানবিক’ হয়ে ওঠার পরামর্শ দিচ্ছেন মল্লিকা। ‘‘মেয়েদের লিঙ্গ তাঁদের পরিচয় নয়। তাঁর ধর্ম, ভাষা, বর্ণটাও নয়। তাই একা মেয়েদের জীবনের চিত্রনাট্য লিখুন তাঁরাই, অন্য কেউ নন।’’— আমদাবাদের উড়ান ধরার তাড়ার মাঝেই বলে গেলেন দৃপ্ত মল্লিকা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement