অনুশীলন: নৃত্যনাট্যের মহড়ায় সহশিল্পীদের সঙ্গে অ্যাসিড আক্রান্তেরা। গল্ফ গ্রিনের এক আবাসনে। নিজস্ব চিত্র
মহড়ায় টান-টান শরীরী ভাষাটা তত রপ্ত হচ্ছিল না গোড়ায়। চোখ-মুখের জ্বালাও ফুটে উঠছিল না।
হামলাকারী খলনায়কের সঙ্গে ধস্তাধস্তির দৃশ্যে অতএব পরিচালকের কিছু নির্দেশ ধেয়ে এল সঞ্চয়িতা যাদবের কাছে। ‘যে ছেলেটা তোমার মুখে অ্যাসিড মেরেছিল, থানায় তার গালে পরপর থাপ্পড় মেরেছিলে না তুমি! সেই সময়টা মনে কর, সেই রাগটা চোখ-মুখে নিয়ে এস দেখি!’
গল্ফ গ্রিনের আবাসনের কমিউনিটি হলে ‘যোদ্ধা’ নৃত্যনাট্যের মহড়ার ছন্দ আর টাল খায়নি। দমদমের সঞ্চয়িতা শুধু একা নন। নদিয়ার পলাশির মেয়ে সাহানারা খাতুন, রিষড়ার ঝুমা সাঁতরা, আমডাঙার কাকলি দাস বা কাকদ্বীপের পম্পা দাসেদের ঘা-খাওয়া চোখমুখ, নুয়ে-পড়া অবয়ব কুণ্ঠার জং মুছে তেজিয়ান হয়ে উঠল।
চোখমুখে অ্যাসিড-ক্ষতের জ্বালাপোড়া ফিরে ফিরে আসে জীবনভর। জ্বালা তো শুধু চামড়ার উপরে নয়। বাধার নিত্যনতুন দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়েও হতাশা গ্রাস করে। কাউকে লড়তে হয় চোখের আলোটুকু হারিয়ে। কেউ বা আয়নার মানবী অবয়বটুকুর সামনেও ফের অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মঞ্চে নাচের মুক্তি এ বার অ্যাসিড-ক্ষতের শিকার কয়েক জনের জন্য সেই গ্লানি মোচনের রাস্তা খুলে দিচ্ছে।
এ দেশের অ্যাসিড-পোড়া মেয়েদের লড়াইয়ের প্রথম সারির মুখ দিল্লির লক্ষ্মী আগরওয়ালের গল্প নিয়ে সিনেমায় অত্যাধুনিক মেকআপে হুবহু অ্যাসিড-ক্ষতের ছাপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দীপিকা পাড়ুকোনের মুখে। নৃত্যনাট্যের আসরে এর ঠিক উল্টো রাস্তায় হাঁটা। অ্যাসিডের ক্ষত নির্যাতিতার কাছে লজ্জা নয়, স্পর্ধার স্মারক— এমনটাই বলে লক্ষ্মী থেকে শুরু করে অনেকেই ফ্যাশন শোয়ের র্যাম্পে হেঁটেছেন আগে। কলকাতায় অলকানন্দা রায়ের পরিচালনায় বছরখানেক আগে একটি অনুষ্ঠানে মিনিট ২০-২৫ এর জন্য মঞ্চে এসেছিলেন কয়েক জন অ্যাসিড-আক্রান্ত তরুণী। এ বার ধারাবাহিক ভাবে অনুষ্ঠান করার লক্ষ্য নিয়ে অ্যাসিড-পোড়া মেয়েদের চরিত্র রেখে কাহিনির প্লট বেছে একটি পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য তৈরি হচ্ছে। ধর্ষণ, যৌনপল্লিতে নারী পাচার, অ্যাসিড-হামলার মতো নারী-নিগ্রহের সঙ্গে লড়াইয়ের একটা ছবি মেলে ধরতেই গোটা ‘স্ক্রিপ্ট’ তৈরি হয়েছে।
সৃষ্টিশীল এই চেষ্টাটুকু নানা ভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন অ্যাসিড-হামলার শিকার অনেক অসহায় মেয়ের লড়াইয়ের ভরসা হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। নৃত্যনাট্যের এই উপস্থাপনার সঙ্গে জড়িত মৌসুমী ভট্টাচার্য, অদ্রিজা ভট্টাচার্য, অসিত ভট্টাচার্য, মহুয়া চক্রবর্তীরা চেয়েছিলেন, জীবনের ঘা খেয়ে পিছু-হটা অ্যাসিড-দগ্ধ মেয়েদেরও এই সৃষ্টিশীলতার শরিক করবেন। মৌসুমী এক সময়ে জেলে বন্দিদের আবৃত্তি শেখাতে যেতেন। পরে মামলায় বেকসুর খালাস বন্দিনী অপরাজিতা ওরফে মুনমুনের সঙ্গে তখনই আলাপ হয় তাঁর। জেল থেকে বেরিয়ে নানা ক্ষেত্রের সক্রিয় সমাজকর্মী অপরাজিতার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই এই নৃত্যনাট্যে জড়িয়ে পড়েছেন সঞ্চয়িতা-ঝুমা-সাহানারা-পম্পা-কাকলিরা।
এই পাঁচ জনের মধ্যে পম্পা ছাড়া বাকিরা সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে হামলাকারীরা বিচারাধীন বা সাজাও পেয়েছে। কিন্তু জীবন এখনও নানা ভাবে ক্ষত-বিক্ষত এই মেয়েদের। প্রবীণ নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়ের মতে, ‘‘নাচের শৃঙ্খলা ও আনন্দ জেলের হতাশাগ্রস্ত বন্দির মতো অ্যাসিড-আক্রান্তদের জীবনেও হারানো ছন্দ ফিরিয়ে আনে। জড়তা ভেঙে আর পাঁচ জনের মাঝে চলাফেরার সাহস জোগায় তাঁদের অনেককেই।’’ দৃষ্টিহীন ঝুমাকে মঞ্চে একটা রোদ চশমা দেওয়া হবে ঠিক হয়েছে। সাহানারা, পম্পারা বলছিলেন, ‘‘এখনও সাজতে ভালবাসি! খুব করে সেজেই মঞ্চে উঠব, কিন্তু!’’ এ মাসের শেষেই রবীন্দ্র সদনে প্রথম শো ‘যোদ্ধা’র। মৌসুমী বলছিলেন, ‘‘অ্যাসিড হানাই জীবনের শেষ নয়, সঞ্চয়িতা-পম্পাদের মাধ্যমে এই বার্তাও মেলে ধরছি আমরা।’’