হাওড়া সেতুতে ওঠার রাস্তায় প্রকাশ্যে এ ভাবেই চলছে জুয়ার ঠেক। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
‘‘ও দাদা, খেলবেন নাকি? ১০ টাকায় ৯০ টাকা। ১০০ টাকায় ৯০০ টাকা। চলে আসুন এ দিকে।’’ প্রশ্ন ও প্রস্তাব, দুটোই ধেয়ে এল একটি বটগাছের নীচ থেকে। সেখানে টেবিল পেতে বসে লাল গেঞ্জি পরা এক যুবক। কানে দামি ব্র্যান্ডের ব্লুটুথ ইয়ারফোন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সুঠাম চেহারার আর এক যুবক। আগন্তুককে দেখে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনিই।
তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করা গেল, কী খেলা? কী ভাবে খেলতে হয়? যা শুনে লাল গেঞ্জির সন্দিহান চোখ বার বার জরিপ করতে লাগল প্রশ্নকর্তাকে। তবে, তিনি কিছু বললেন না। উত্তর দিলেন তাঁর পাশে দেহরক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই সুঠাম যুবকই। সামনে রাখা একটি কাগজের বোর্ডে কয়েকটি চৌকো ঘর আঁকা এবং হাতে লেখা কিছু নম্বর। সেই বোর্ড দেখিয়ে সুঠাম চেহারা বললেন, ‘‘এখানে দেখুন, মোট ন’টা ঘর আছে। প্রতিটি ঘরের রেট ১০ টাকা। টাকা দিলেই একটা কাগজের স্লিপে আপনার বুকিং নম্বর লিখে দেব। সকাল থেকে দিনে চার বার লটারি হয়। রাত ৮টা পর্যন্ত চলে। লটারি লেগে গেলে আপনি টাকা পেয়ে যাবেন।’’
যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছে, সেটি হাওড়া স্টেশনের ১৩ এবং ১৪ নম্বর সাবওয়ে দিয়ে বেরিয়ে হাওড়া সেতুতে ওঠার জনবহুল রাস্তা। সামনেই হাওড়া স্টেশনের দিকে যাওয়ার পথ। রাস্তার ও-পারে গঙ্গা। সাবওয়ে থেকে বেরোলেই দেখা যায়, রাস্তার উল্টো দিকে একটি বটগাছের নীচে সস্তার টেবিল-চেয়ার পাতা। সেখানেই ওই দুই যুবককে ঘিরে জমে উঠেছে জুয়াড়িদের ভিড়। পুলিশের একেবারে নাকের ডগায় প্রকাশ্যেই চলছে জুয়ার ঠেক। শুধু ওই জায়গায় নয়, হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড, হাওড়া সেতু সংলগ্ন রাস্তা, গঙ্গার ধার— সর্বত্রই রমরমিয়ে চলছে জুয়ার অবৈধ কারবার। চাঁদমারি ঘাটের উল্টো দিকে, অন্য একটি জুয়ার ঠেকের প্রৌঢ় ‘বুকি’ (জুয়ার সব হিসাবপত্র রাখা ও ঠেক পরিচালনার কাজ যিনি করেন) বললেন, ‘‘আমাদের এখানে দু’রকম খেলা হয়। একটা হল ‘রাঁচী ঝটপট’ এবং দ্বিতীয়টা ‘কলকাতা ফটাফট’। রাঁচী ঝটপটে টাকা লাগালে মোটা টাকা উঠতে পারে।’’ ওই প্রৌঢ়ের দাবি, বহু গরিব মানুষ ও দিনমজুর নাকি দু’পয়সা বেশি আয়ের জন্য প্রতিদিন সেখানে জুয়া খেলেন।
কিন্তু হাওড়া স্টেশনের মতো এলাকায় প্রকাশ্যে এতগুলি জুয়ার ঠেক কী ভাবে চলছে?
হাওড়া সিটি পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রের খবর, হাওড়া স্টেশন চত্বর ও হাওড়া-কলকাতা বা হাওড়া-দিঘা বাসস্ট্যান্ড ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন করছেন কিছু লোক। তাঁদের মদতেই হাওড়া স্টেশন, গঙ্গার ধার থেকে বাসস্ট্যান্ড— সর্বত্র গজিয়ে উঠেছে একের পর এক বেআইনি হোটেল, বেআইনি মদের ঠেক, বেআইনি ট্যাক্সিস্ট্যান্ড এবং জুয়ার ঠেক। চলছে ট্রেনের টিকিটের কালোবাজারিও। যে ‘দাদারা’ এই সমস্ত কারবার চালান, তাঁদের সকলেরই রাজনৈতিক জগতে ওঠাবসা রয়েছে। এবং ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে দ্রুত নিজেদের রংও পাল্টে নেন তাঁরা। অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের একাংশ এই সমস্ত ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পান। তাঁদের সক্রিয় ‘সহযোগিতা’ পেয়েই বিভিন্ন রকম অবৈধ ব্যবসা পল্লবিত হয়ে হাওড়া স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড চত্বরকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। এই চক্রের হাত ধরেই গত এক বছর ধরে শুরু হয়েছে জুয়ার আড্ডা।
প্রকাশ্যে চলা জুয়ার ঠেক নিয়ে স্থানীয় দোকানদার ও হোটেল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, জুয়ায় হেরে নিত্যদিন বহু গরিব মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। তা ছাড়া, জুয়ার টানে প্রচুর দুষ্কৃতী রোজ ভিড় জমাচ্ছে স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড চত্বরে। আরও অভিযোগ, ‘মাসোহারা’র ব্যবস্থা থাকায় পুলিশ বা রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ এ সব দেখেও দেখেন না। নালিশ জানিয়েও কোনও লাভ হয় না। ব্যবসায়ীদের দাবি, স্টেশন লাগোয়া গঙ্গার ধার থেকে বঙ্কিম সেতু সংলগ্ন মাছ বাজার পর্যন্ত অংশ বর্তমানে তোলাবাজির স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর প্রতিকার কী ভাবে সম্ভব, তার উত্তর নেই কারও কাছেই। (চলবে)