Swasthya Sathi

স্বাস্থ্যে বরাদ্দই বারো হাজার কোটি, তবে স্বাস্থ্যসাথী হবে কোন খাতে

এখনই বিস্তর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে গেরুয়া কার্ড নিয়ে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ নামের ওই কার্ডে চিকিৎসা পেতে প্রান্তিক মানুষকে এনএবিএল ছাপযুক্ত কর্পোরেট হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে।

Advertisement

মানস গুমটা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০৩:০৯
Share:

উৎসাহী: স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করাতে এ ভাবেই লাইন দিচ্ছেন মানুষ। ফাইল চিত্র

গেরুয়া কার্ড বনাম নীল-সাদা কার্ড। দুইয়ের দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে আপাতত প্রথম পক্ষকে ‘লাল কার্ড’ দেখিয়ে রাজ্যের বাইরে আটকে রেখেছে দ্বিতীয় পক্ষ। কিন্তু এই লড়াইয়ে ‘দর্শক’ নাগরিকের কী হাল, খোঁজ রাখছে না কোনও পক্ষই। খোঁজ রাখছে না সমাজ। আসল পরিস্থিতি জানেন না সেই ‘দর্শক’, যাঁদের জন্য বিশেষ দুই কার্ডের পরিকল্পনা।

Advertisement

এখনই বিস্তর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে গেরুয়া কার্ড নিয়ে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ নামের ওই কার্ডে চিকিৎসা পেতে প্রান্তিক মানুষকে এনএবিএল ছাপযুক্ত কর্পোরেট হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। তাঁদের পক্ষে কি সম্ভব ছোট অস্ত্রোপচারের জন্য লোটা কম্বল বেঁধে, খোরাকি দিয়ে লোক নিয়ে বড় শহরে চিকিৎসা করানো? ওই কার্ডে চিকিৎসা হবে না বলে রোগী ফেরানোর অভিযোগও ভূরি ভূরি। অজুহাত, প্যাকেজে পোষাচ্ছে না বা সরকার বিল মেটাচ্ছে না। তবে ওই কার্ডের এ রাজ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় দেশের ১০ কোটি পরিবারের অন্তর্গত ৫০ কোটির আওতায় পড়া হল না রাজ্যবাসীর।

অন্য দিকে, নীল-সাদা কার্ড। যার সুবিধা নাকি ১০ কোটি রাজ্যবাসী পাবেন। সেই বার্তা রটিয়ে ওই ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড বিতরণ করতে নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘দুয়ারে সরকার’। সংবাদমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে ওই কার্ডপ্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন। অথচ কেউ প্রশ্ন করেননি, ১০ কোটি মানুষের জন্য দু’কোটি পরিবারকে বছরে ৫ লক্ষ টাকা করে স্বাস্থ্য বিমা দিতে বাজেটে সংস্থান আছে তো? প্রশ্ন তোলেননি, বিনামূল্যে উন্নত সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা যখন রাজ্যে রয়েছে, তবে এত মানুষ লাইনে কেন? ঘোষণা অনুযায়ী, ১০ কোটি মানুষের পাঁচ শতাংশও যদি চিকিৎসা চান, তা হলে প্রতি বছর রাজ্যের খরচ হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। যা প্রতি তিন মাসে সাড়ে বারো হাজার কোটি টাকা! অথচ বর্তমান অর্থবর্ষে রাজ্যের পুরো স্বাস্থ্যে বরাদ্দ প্রায় বারো হাজার কোটি টাকা! যা রাজ্যের জাতীয় মোট উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৯ শতাংশ। তা হলে টাকা আসবে কোথা থেকে?

Advertisement

আরও পড়ুন: ‘বাধ্য’ হয়েই কি স্বাস্থ্যসাথীতে নাম নতুন ২০ হাসপাতালের

আরও পড়ুন: বাড়ি ফিরলেন আইনি জটে ‘পাগল’ তকমায় বন্দি যুবক

সবাই প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছেন, দৈনিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার চাপে যে বড় অংশের মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছেন, স্বাস্থ্যসাথী তাঁদের সুরাহা দেবে কি না? কেউ জানতে চাইছেন না, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, প্রতিষেধক-চিকিৎসা নিয়ে সরকারের ভাবনা কী?

দুই কার্ডের শুরুর পর্বে রাজনৈতিক মুখের ছবি থাকা নিয়ে মনোমালিন্য শোনা গেলেও আসল গোল অন্যত্র। দু’টি কার্ডের সঙ্গে যুক্ত আলাদা আলাদা ব্যবসায়ী সংস্থা কোথায় ব্যবসা করবে, সেটাই ছিল মূলে। দেশব্যাপী উৎপাদন শিল্প এবং বিভিন্ন পরিষেবা মন্দার কবলে পড়লেও, স্বাস্থ্যের ব্যবসায় সেই ছাপ পড়েনি। অতিমারিতে বরঞ্চ ফুলে উঠছে। সেই ধারা বজায় থাকছে দুই কার্ডের আড়ালে। কোন ব্যবসায়ীর পিছনে কোন সরকার, তাতেই নির্ভর করবে জনগণের কার্ড-ভাগ্য।

যার জোরেই সরকারি হাসপাতালে এখন ভর্তি হলে নীল-সাদা ব্যাজ পরা স্বাস্থ্যকর্মী অযাচিত ভাবে খোঁজ নিচ্ছেন কার্ড আছে কি না। থাকলে জামাই আদর জুটছে। ওই কার্ড যন্ত্রে ঢুকে যাবে। আপনাকে নিশ্চিন্ত করা হবে, চিকিৎসা নিখরচার। বাড়ি ফেরার ভাড়া পাবেন। তবে মাটিতে, ট্রলিতে নাকি শয্যা ভাগ করে থাকতে হবে, তা জানার সুযোগ নেই। প্রতিটি হাসপাতালে এখন ‘মে আই হেল্প’ ডেস্কের কাজ ওয়ার্ড চিনিয়ে দেওয়া নয়, কোথায় স্ক্যান হবে বলে দেওয়া নয়, কোথায় ট্রলি আছে তার দিশা দেওয়া নয়। কাজ একটাই, ওই কার্ড আছে কি না খোঁজ নেওয়া। কোনও ভাবে কার্ড না দেখিয়ে ভর্তি হলেও আপনার খোঁজে তাঁরা হাজির হয়ে যাবেন ওয়ার্ডে। তবে বহির্বিভাগে টিকিটের লাইন, পরীক্ষার অনন্ত অপেক্ষা, অস্ত্রোপচারের তারিখ পেতে বছর ঘোরা, ওষুধ না পাওয়ার যন্ত্রণা ভাগ করতে তাঁদের দেখা গিয়েছে, এমনটা এখনও শোনা যায়নি।

নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নাকি সব থেকে বেশি আয় করেছে ওই কার্ডে স্বাস্থ্য বেচে। গত বছরের হিসেবে ছিল, প্রায় চার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে তারা। অন্য মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালও পিছিয়ে নেই। তবে সরকারি হাসপাতালেও স্বাস্থ্য বিক্রি হচ্ছে?

গোল বাধছে একটি বিষয়ে। বিনামূল্যে চিকিৎসার এত বিজ্ঞাপন। অথচ একই জায়গায় দু’রকম ব্যবস্থা কেন? আপনাকে কি বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে কার্ড? বিশেষ খাবার, যত্ন, নার্সদের নজর, বিনামূল্যে আয়া, নতুন চাদর বা ছারপোকা ছাড়া শয্যা? সব উত্তরই ‘না’।

পাশের শয্যায় যাঁর কার্ড নেই তাঁদের চিকিৎসা কেমন হচ্ছে? জানা যাচ্ছে, দু’ক্ষেত্রেই এক ডাক্তার, এক ব্যবস্থা। কার্ডধারীর অস্ত্রোপচারের তারিখ আগে পাওয়ার আশা নেই, আগে পরীক্ষার নিশ্চয়তা নেই। ট্রলি ঠেলতে গাঁটের কড়ি ফেলতেই হবে। এও হতে পারে, কার্ড থাকা সত্ত্বেও আপনি মাটিতে বা ট্রলিতে, আর কার্ড ছাড়া রোগী শয্যায়।

তা হলে? নিখরচায় পরিষেবা দেওয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে গোটা পরিবারের জন্য কার্ডে যে টাকা ছিল তা শেষ হয়ে যাচ্ছে না তো? ভেবে দেখেছেন কি সেটা?

(শিক্ষক-চিকিৎসক, কলেজ অব মেডিসিন অ্যান্ড সাগর দত্ত হাসপাতাল)

(মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement