গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। ওই অধ্যাপক একটি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান। ছাত্রীর অভিযোগ, তিনি ওই ছাত্রীকে পরীক্ষার হল থেকে তুলে নিয়ে পরোক্ষে যৌন চাহিদা মেটানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় ছাত্রীর কাছে দুই সিনিয়র ছাত্রের মাধ্যমে সরাসরি ওই প্রস্তাব দেন তিনি। ছাত্রীর অভিযোগ, পরীক্ষা শেষের পরই তাঁর বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের দুই ছাত্র তাঁকে বলেন, ‘‘ভাল ভাবে পরের পরীক্ষাগুলো দিতে চাইলে ....স্যরের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে হবে। বাকি কোনও অসুবিধা যাতে না হয়, তা আমরা দেখে নেব!’’
গোটা ঘটনায় হতভম্ব ওই ছাত্রী একটি ইমেলের মাধ্যমে ঘটনাটি জানিয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু-সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শীর্ষ পদাধিকারীকে। ইমেল পাঠানো হয়েছে যাদবপুর থানাতেও। ওই ইমেল আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে এসেছে। যেখানে ছাত্রী বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন ঘটনার দিন এবং তার আগে তাঁর সঙ্গে হওয়া ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছি। আমি জানি না আমার এর পর কী করা উচিত। কেন আমার সঙ্গেই এমন হচ্ছে। আমার সম্মান নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। আমি শুধুই সুবিচারের আশা করছি।’’ যদিও ছাত্রীর এই অভিযোগ মানতে চায়নি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন (জুটা)। তাদের দাবি, গোটাটাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক।
আনন্দবাজার অনলাইনকে ওই ছাত্রী জানিয়েছেন, তিনি কলকাতার বাসিন্দা নন। শহরে ‘পেয়িং গেস্ট’ হিসাবে থাকেন। ইমেলে ওই ছাত্রী কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, তিনি রাজ্যের গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে পড়াশোনা করতে এসেছেন। কলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয় বলে জানতেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাই অনেক আশা নিয়ে সেখানে এসেছিলেন স্নাতকোত্তর পড়তে। ছাত্রী লিখেছেন তিনি কখনও পরীক্ষায় খারাপ ফল করেননি। মাধ্যমিক ৬০ শতাংশ এবং উচ্চমাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বাংলায় সাম্মানিক স্নাতকও হয়েছেন ৭৪ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে। যাদবপুরে ভর্তির পরীক্ষায় ১০০-র মধ্যে ৯০ নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। কিন্তু ক্লাস শুরুর পর থেকেই বুঝতে পারছিলেন, গ্রাম থেকে আসা এক ছাত্রীর ভাল নম্বর পাওয়াকে ভাল চোখে দেখেননি ওই অধ্যাপক। মাঝেমধ্যেই সহপাঠীদের সামনে ওই ছাত্রীকে নিয়ে এই বিষয়ে ঠাট্টা করতেন তিনি। সেটা খারাপ লাগলেও এড়িয়ে যাওয়াই ভাল বলে মনে করেছিলেন ছাত্রী। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পর তাঁর মনে হচ্ছে, প্রথম দিন থেকেই ওই অধ্যাপকের ‘লক্ষ্য’ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
ইমেলে ওই ছাত্রী লিখেছেন, ঘটনার শুরু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রথম বর্ষের প্রথম পরীক্ষার দিন। পরীক্ষার হলে আচমকাই ওই অধ্যাপক সবার সামনে তাঁর নাম ধরে ডাকেন এবং বলেন, তাঁকে শারীরিক তল্লাশি নিতে হবে, কারণ তিনি চিরকুটে পরীক্ষার উত্তর লিখে এনেছেন। ছাত্রীর কথায়, ‘‘পরীক্ষার হলে আমার পুরুষ সহপাঠীরাও ছিল। কিন্তু তাঁদের সামনে আর কোনও মহিলা সহপাঠীকে এমন তল্লাশির কথা বলা হয়নি। একমাত্র আমাকেই সবার সামনে অস্বস্তিকর ভাবে শরীরে হাত দিয়ে তল্লাশি করা হয়। ঘটনাটা আমার কাছে অপমানজনক লাগছিল। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। কারণ, ওই অধ্যাপক বলেছিলেন, হয় তল্লাশি করতে দিতে হবে, নয়তো পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।’’ ওই ঘটনায় অবশ্য কোনও চিরকুট ছাত্রীর থেকে পাওয়া যায়নি। সে দিনের মতো পরীক্ষা দিতে পারেন তিনি। কিন্তু তার পর আবার ধাক্কা খান পরের পরীক্ষার দিন।
বুধবার ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর প্রথম বর্ষের প্রথম সেমেস্টারের দ্বিতীয় পরীক্ষা। ছাত্রী জানিয়েছেন, প্রায় দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার পর হঠাৎই পরীক্ষার হলে যিনি গার্ড দিচ্ছিলেন, তিনি তাঁর নাম ধরে ডেকে বলেন তাঁকে ওই অধ্যাপকের ঘরে ডেকে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষা ছেড়ে ছাত্রীকে নিয়ে ওই গার্ড, যিনি তাঁর বিভাগের এক জন গবেষণার ছাত্রীও, আসেন অধ্যাপকের ঘরের বাইরে। নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি ওই ছাত্রীকে ঘরের ভিতরে যেতে বলেন।
ছাত্রী লিখেছেন, অধ্যাপক তাঁকে দেখে প্রথমেই তাঁর হাত সজোরে ধরে ঘরের মধ্যে টেনে আনেন। ছাত্রী প্রায় কান্নাকাটি করেই তাঁকে অনুরোধ করেন তাঁকে পরীক্ষার হলে ফিরে যেতে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অধ্যাপক কথা না শুনে ওই ছাত্রীর হাতের উপর একপ্রস্ত কালি ঢেলে দিয়ে বলেন, ‘‘তুমি হাতে পরীক্ষার উত্তর লিখে এনেছো।’’ ছাত্রীর কথায়, ‘‘এই অভিযোগ শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমি তাঁকে বলি, ‘এই হাতের ছবি আমি তুলে রাখতে চাই, যাতে আপনি যা বলছেন, তার প্রমাণ থাকে আমার কাছে। যে ভাবে আমার উপর শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে সে বিষয়ে আমি অভিযোগও জানাতে চাই কর্তৃপক্ষের কাছে’।’’ ছাত্রী জানিয়েছেন, সে কথা শুনেই অধ্যাপক তাঁকে টেনে এনে তাঁর হাত সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে ধুয়ে দেন এবং বাংলায় তাঁকে বলেন, ‘‘আমি যা চাইছি, তুমি যদি তা না করো এবং যদি আমার চাহিদা না মেটাও তবে আমি তোমাকে চিরতরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার করে দেব।’’
ছাত্রী জানিয়েছেন, এখানেই তাঁর উপর নির্যাতন শেষ হয়নি। ওই অধ্যাপক তাঁকে এর পর টেনে নিয়ে যান তাঁর বিভাগীয় প্রধানের কাছে। ছাত্রীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও করেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত বিভাগীয় প্রধান আস্থা রাখেন ছাত্রীর উপরেই। তাঁকে পরীক্ষার হলে যাওয়ার অনুমতিও দেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ছাত্রী লিখেছেন, পরীক্ষার হলে তিনি পৌঁছন পরীক্ষার শেষের ঘণ্টা বাজার দু-তিন মিনিট আগে। তবু বিধ্বস্ত মনে পেন নিয়ে লিখতেও শুরু করেছিলেন কিন্তু তাঁকে আবার বাধা দেন ওই অধ্যাপক। বাধ্য করেন, তাঁর লেখা পরীক্ষার খাতার প্রতিটি পাতায় কাটা চিহ্ন দিতে। ওই ভাবেই পরীক্ষার খাতা জমা দিতে হয় তাঁকে। কাঁদতে কাঁদতেই হল ছাড়ছিলেন তিনি। কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ান তাঁরই বিভাগের দুই সিনিয়র ছাত্র।
ইমেলে ছাত্রী লিখেছেন, তাঁরাই ওই অধ্যাপকের সঙ্গে শারীরির সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন তাঁকে। এমনও বলেন, ওই দিনই ‘অধ্যাপকের সঙ্গে গিয়ে একান্তে দেখা’ করতে হবে। কারণ, যৌন সম্পর্কই ‘অধ্যাপকের রাগ’-এর হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। ছাত্রী লিখেছেন, ‘‘আমি বুঝতে পারি অধ্যাপকের কথা বুঝতে না পারায় তিনি ওই ছাত্রদের দিয়ে তাঁর প্রস্তাব পাঠিয়েছেন আমার কাছে।’’
এর পরেই ওই ছাত্রী বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে মনস্থ করেন। গোটা ঘটনাটি লেখেন ইমেলে। তবে তার পরও ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছেন তিনি। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘আমি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। পরীক্ষা চলছে। কিন্তু আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হচ্ছে। এখনও দু’ বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে পড়াশোনা করতে হবে। আগামী দিনগুলো কী ভাবে কাটবে, তা ভেবে আতঙ্কে ভুগছি আমি।’’
তবে এ ব্যাপারে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপক বলেন, ‘‘আমি ওই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। এবং সংশ্লিষ্ট জায়গায় বিষয়টি জানিয়েওছি। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।’’
যাদবপুরের আরও এক অধ্যাপক অভিষেক দাস ঘটনার সময় অন্য হলে দায়িত্বে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি ওখানে যান বলে আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন অভিষেক। তিনি বলেন, ‘‘আমি গিয়ে দেখি ওই ছাত্রীর হাতে বিভিন্ন তথ্য লেখা রয়েছে। সেই লেখা দেখে তিনি খাতায় লিখছিলেন। তা নিয়েই আপত্তি তোলেন পরিদর্শক। আমার সামনেই ওই ছাত্রী স্বীকার করেন, তিনি ওই লেখা দেখে খাতায় লিখছেন। তবে তাঁকে পরীক্ষা ছেড়ে উঠে যেতে বলা হয়নি। তাঁকে দু’টি বিকল্প দেওয়া হয়। হয় তিনি নতুন খাতা নিন অথবা ওই খাতায় যা লেখা হয়েছে তা কেটে দিন। তিনি দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নেন। তার পরে তিনি কেন এই ধরনের অভিযোগ করেছেন, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। ’’
অন্য দিকে, জুটার তরফে অধ্যাপক পার্থপ্রতিম রায়ের বক্তব্য, ‘‘ওই ছাত্রী মিথ্যা অভিযোগ করছেন। এটি আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। ওই ছাত্রী হলে প্রতারণার মাধ্যমে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি উত্তর টুকে এনেছিলেন। তাঁকে বাধা দেন হলের পরিদর্শক। তিনিই ওই অধ্যাপককে ডেকে নিয়ে আসেন। ওই অধ্যাপককে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনও অভিযোগ অতীতে ওঠেনি। এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে এর পরে পরীক্ষকেরা আর পরীক্ষার হল পরিদর্শনে উপস্থিত থাকবেন না।’’