—ফাইল চিত্র।
জলমগ্ন অবস্থা থেকে ‘উদ্ধার’ করতে শহর সংলগ্ন খালগুলি সংস্কারের একটি ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর, সেচ দফতর ও কলকাতা পুরসভার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে গত সপ্তাহে সেই রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে।
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘খালগুলি নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে সেচ দফতরের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে।’’ সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রও বলছেন, ‘‘রোডম্যাপ অনুযায়ী খাল সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।’’ যদিও গবেষক-বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ওই রোডম্যাপ তৈরি হয়েছে অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে। কারণ, তথ্য বলছে, শহরের ৫৫ শতাংশ নিকাশি সংযোগই ভূগর্ভস্থ প্রধান নিকাশি নালাগুলির সঙ্গে সংযুক্ত। তার উপরে ভিত্তি করেই বলা হয়, শহরে দৈনিক প্রায় ৭৫ কোটি লিটার নিকাশি বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
জলাভূমি-গবেষক ধ্রুবা দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, ৫৫ শতাংশ বাড়ি, আবাসন বা অন্য ‘এস্ট্যাব্লিশমেন্ট’-এর নিকাশি লাইন ‘সাব সুয়ার’-এর (বাড়ি ও প্রধান নিকাশি নালাগুলির মধ্যবর্তী সংযোগকারী নিকাশি লাইনগুলি) সঙ্গে যুক্ত। সেই ‘সাব সুয়ার’ আবার ভূগর্ভস্থ প্রধান নিকাশি নালাগুলির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সেই প্রধান নালাগুলি গিয়ে পড়ছে খালগুলিতে। তাঁর কথায়, ‘‘বাকি ৪৫ শতাংশ নিকাশি ও তরল বর্জ্য কোথায় যাচ্ছে, তার একটা সম্পূর্ণ হিসেব পেতে গেলে আগে নিকাশি নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ, শহরে যত বাড়ি, আবাসন রয়েছে, তার প্রতিটির নিকাশির সংযোগ, সাব সুয়ারের মাধ্যমে প্রধান ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালাগুলির সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। সেটা যত ক্ষণ না হচ্ছে, তত ক্ষণ নিকাশির সামগ্রিক চিত্রটা পরিষ্কার হবে না।’’
গবেষক-বিশেষজ্ঞেরা এ-ও জানাচ্ছেন, শহর সম্প্রসারণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিকাশি নালার পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এক গবেষকের কথায়, ‘‘অপরিকল্পিত ভাবে শহর গড়ে উঠেছে। এমনও হয়েছে যে আগে বসতি গড়ে উঠেছে। তার পরে নিকাশি পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে।’’ পরিবেশবিজ্ঞানী তপন সাহা জানাচ্ছেন, শহরে পুকুর, জলাশয় যে ভাবে বোজানো হয়েছে বা ক্রমাগত হয়েই চলছে, তা-ও নিকাশি পরিকাঠামোর উপরে বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘পুকুর, জলাশয়গুলি বৃষ্টির জল ধরে রাখতে পারত। কিন্তু সেগুলো বোজানোর কারণে এলাকাভিত্তিক জলমগ্ন অবস্থা তৈরি হচ্ছে।’’ শহরের অন্যতম দুই খাল, বাগজোলা ও কেষ্টপুর খাল নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘খালগুলির সংস্কার করা না হলে জল জমার সমস্যা কোনও দিনই মিটবে না।’’
এই পরিস্থিতিতে চড়িয়াল, মণিখাল, বাগজোলা, কেষ্টপুর-সহ একাধিক খালের পলি নিষ্কাশন-সহ সামগ্রিক খাল সংস্কার নিয়ে ‘গাফিলতি’র বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। কোথাও কোনও খালের সম্প্রসারিত অংশ বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও আবার নিকাশি পরিশোধন প্লান্ট (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) বছরের পর বছর ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
যদিও ‘জলমগ্ন অবস্থা থেকে কলকাতা এখন মুক্তি পেয়েছে। কলকাতা পুরসভাকে তার জন্য ধন্যবাদ।’— বছর ছয় আগে রাজ্যের শাসকদলের ওয়েবসাইটে এমন ভাবেই শহরের নিকাশি পরিকাঠামোর উন্নতি নিয়ে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। পুরসভার নিকাশি দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য তারক সিংহও বলছেন, ‘‘সেচ, পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই খাল সংস্কার-সহ নিকাশি সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে।’’
কিন্তু তাতে জল জমার সমস্যা মিটছে কি? শহরবাসীর অভিজ্ঞতা কিন্তু শাসকদলের ওয়েবসাইট বা কলকাতা পুরসভার দাবির সঙ্গে মিলছে না!