আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। —ফাইল চিত্র।
সেই মেয়েটির কথা এখন সারা বিশ্ব জানে। তাঁর নৃশংস মৃত্যু এবং ধর্ষণের ঘটনা আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে মানুষকে। এবং আমরা, যে ডাক্তারেরা নিয়মিত সরকারি হাসপাতালগুলিতে ৩৬ থেকে ৪০ ঘণ্টা ‘ডিউটি’ করি, রাতে ‘অন কল’ থাকি, আমরাই জানি, কী অবস্থায় এই কাজ করতে হয়। কী ভাবে নিরাপত্তার নামে ঠুনকো একটি শব্দকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আমরা কাজ করে যাই। রাতের পর রাত।
আমি নিজের হাসপাতাল— কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কথাই বলব। অন্য সরকারি হাসপাতালগুলির মতো এটিও বাইরে থেকে ঝাঁ চকচকে। নীল-সাদা রং, বড় বড় দরজা। কিন্তু ভিতরে? শুনতে অবাক লাগবে, এই হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তারদের জন্য একটিই মাত্র ‘অন কল রুম’ বরাদ্দ। অর্থাৎ পুরুষ ও মহিলা ডাক্তারদের জন্য কোনও আলাদা ঘরের ব্যবস্থা নেই। শৌচাগারও একটাই। এবং তার হাল ভয়ঙ্কর।
আগেই বলেছি, আমাদের সাধারণত এক একটি ডিউটি টানা ৩৬ থেকে ৪০ ঘণ্টা ধরে চলে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা দীর্ঘায়িতও হয়। এই রকম লম্বা কাজের শেষে যখন আমাদের শরীরকে ক্লান্তি গ্রাস করে, তখনও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ নেই। আমরা বাধ্য হই সেই ‘অন কল রুমে’ই বিশ্রাম নিতে। সেই ঘরই আমরা, মেয়ে ডাক্তারেরা ভাগ করে নিই বন্ধু, জুনিয়র বা সিনিয়র পুরুষ ডাক্তারদের সঙ্গে।
এই সময়ে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, কে দায়িত্ব নেবে? কেন আমি বিশ্রামের সময়ে পুরুষ বন্ধু বা সিনিয়র-জুনিয়রের সঙ্গে ঘর ভাগ করব?
যে ঘরে আমরা বিশ্রাম নিই, সেখানে সকলের যাতায়াতও অবাধ। কত দিন এমন ঘটেছে যে, ‘অন কল রুমে’র খাটে শুয়ে আছি, মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়েছে তখন, দরজায় কোনও টোকা না দিয়েই দিব্যি রোগীর বাড়ির লোক ঢুকে পড়েছে সেই ঘরে! ঘরে যাতে এ ভাবে কেউ হুট করে ঢুকতে না পারে, সেটা দেখার দায়িত্ব কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী বা পুলিশের। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
এগুলিই কিন্তু বিপদ সঙ্কেত। এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকারি হাসপাতালের অন্দরমহলে যে কোনও সময়ে, যে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতেই পারে। এই নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে পাল্টা যুক্তি উঠতেই পারে, ধর্ষণের মতো কোনও ঘটনা ঘটেছে কি? কোনও যৌন নিগ্রহ? আমার প্রশ্ন, তা হলে কি যতক্ষণ একটি নৃশংস ঘটনা বা ধর্ষণের মতো ঘটনা না ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা সরকার কোনও পদক্ষেপ করবেন না? ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা শুধু হাসপাতালের বহিরঙ্গকে ঝাঁ চকচকে করে তোলাকেই মূল কাজ বলে মনে করবেন? মহিলা ডাক্তারদের নিরাপত্তাকে নয়?
এ ক্ষেত্রেও তো তা-ই হল। আর জি করের সেই চিকিৎসক-ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের পরে একে একে সামনে আসছে সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষদের গলদের দিকগুলি। তা হলে এত দিন কেন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি?
কর্মক্ষেত্র আমাদের কাছে দ্বিতীয় বাড়ির সমান। সেখানেই যদি নিরাপত্তার অভাব হয়, তা হলে আমরা কী করে নিজের কাজটা করব? কী ভাবে মুমূর্ষু মানুষদের সুস্থ করে তুলব?