প্রতীকী ছবি।
‘‘আপনার অ্যাকাউন্টে দেখা যাচ্ছে, ২৫ লক্ষ টাকা জমা দিয়ে আবার তুলেও নিয়েছেন। এত টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে এল কী ভাবে? যে পদ্ধতিতে টাকাটা হাতিয়েছেন, তার নাড়িনক্ষত্র আমাদের জানা। দেখা করুন।’’ আচমকা লালবাজার বা কোনও তদন্তকারী সংস্থা থেকে এমন ফোন এলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা হতে পারে যে কারও। এমনকি আপনি যদি দেখেন আপনার অ্যাকাউন্টে আগের মতোই অল্প কিছু টাকা পড়ে রয়েছে, তা হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না। আপনার মনে প্রশ্ন আসবে, পুলিশ এত টাকার কথা বলছে কিসের ভিত্তিতে?
তদন্তকারী সংস্থার মুখোমুখি হয়ে আপনার মনে পড়তে পারে, সম্প্রতি আপনার কাছে একটি ফোন এসেছিল। ফোনে আয়কর বিভাগের কর্মী পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি আপনার প্যান কার্ডের নম্বর, সেটির সঙ্গে আধার কার্ড যোগ করা আছে কি না— সে সব জানতে চেয়েছিল। সব করা রয়েছে জানানোর পরেও বলা হয়েছে, আয়কর বিভাগের নথিতে এমন প্রমাণ নেই। ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি এর পরে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘‘আধার-প্যান যোগ করার জন্য কোন ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছিল?’’ আপনি সেই ফোন নম্বর বলে দিয়েছিলেন। তার পরে বলা হয়েছিল, ‘‘আধারের সঙ্গে প্যান কার্ডের সংযুক্তিকরণ করা নেই। এই নম্বর দিয়ে ফের দু’টি যোগ করে দেওয়া হচ্ছে। নম্বরটি ঠিক কি না জানার জন্য আপনার ফোনে ওটিপি যাবে, সেটা বলতে হবে।’’ আপনি সেটাও বলে দিয়েছিলেন। এত কিছুর পরেও আপনার সন্দেহই হয়নি, কারণ টাকা-পয়সা কিছুই খোয়া যায়নি। উল্টে ভেবেছেন, বাড়িতে বসেই তো গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হয়ে গেল!
এখানেই তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, করোনাকালে প্রায় সব ব্যাঙ্কই অনলাইনে অ্যাকাউন্ট খোলার উপরে জোর দিচ্ছে। আর সেটাই হাতিয়ার করে জামতাড়া গ্যাং অন্যের আধার নম্বর, প্যান কার্ড নম্বর এবং ফোন নম্বর দিয়ে খুলছে একের পর এক ডিজিটাল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। অনলাইন কারচুপিতে এক জনের অ্যাকাউন্ট থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা পাঠানো হচ্ছে সেই ডিজিটাল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। সময় মতো তা তুলেও নেওয়া হচ্ছে। মূল অপরাধী থাকছে অধরা। উল্টে তদন্তে নেমে ওই ডিজিটাল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে পুলিশ যাঁর কাছে পৌঁছচ্ছে, তিনিও আসলে অন্য অর্থে প্রতারিত!
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, ওই গ্যাংয়ের সদস্যেরা আরও যে সব পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তার মধ্যে অন্যতম ‘বাল্ক মেসেজ’। সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে পারলেই এই মুহূর্তে দেশের যে কোনও প্রান্তে দিনে ৫০ হাজার বাল্ক মেসেজ পাঠানো যায়। সেই মেসেজের কোনওটিতে কেওয়াইসি আপডেট করতে বলা থাকে, কোনওটিতে দেওয়া হয় খাবারের অফার। সমাধান হিসাবে দেওয়া থাকে হয় একটি ফোন নম্বর অথবা একটি লিঙ্ক। কেউ সেই লিঙ্কে ক্লিক করলে তো বটেই, এমনকি সেই নম্বরে ফোন করলেও কথার কৌশলে সেই লিঙ্কেই ক্লিক করিয়ে ‘কুইক সাপোর্ট’ বা ‘এনি ডেস্ক’ নামে অ্যাপ ডাউনলোড করানো হয় প্রতারিতের ফোনে। সঙ্গে সঙ্গে সেই ফোনের দখল চলে যায় জামতাড়া গ্যাংয়ের হাতে।
লালবাজারের সাইবার শাখার এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানার জামতাড়া, কর্মাটাঁড়, দেওঘর, নারায়ণপুর-সহ একাধিক জায়গায় দীর্ঘদিন কাটিয়ে তিনি দেখেছেন, এই ব্যবসা চলে একটি চক্রের মতো। টাকার বখরা ভাগ হয় তিনটি অনুপাতে। ফোনে কথা বলে যে প্রথম প্রতারণার ফাঁদ পাতে, সে নেয় ৪০ শতাংশ। হাতিয়ে নেওয়া টাকা ব্যাঙ্ক থেকে যে তোলে, তার বরাদ্দ ৪০ শতাংশ। তৃতীয় একটি দল থাকে, যারা নিত্যনতুন প্রতারণার কৌশল ভেবে বার করে। তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে ২০ শতাংশ। সূত্রের খবর, প্রতারকদের লক্ষ্য থাকে যত লোকের কাছে বাল্ক মেসেজ বা ফোন যাচ্ছে, ১৫ দিন অন্তর তার মাত্র ১০ শতাংশকে নিশানা করা। সেই ১০ শতাংশ লোক ফাঁদে পা দিলেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না তাদের।