মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গীতা। —নিজস্ব চিত্র।
পুকুরের ধার দিয়ে কাঁচা মাটির সরু রাস্তা, ছোট ছোট কামরার টালির ঘর। সে সব পিছনে ফেলে যেখানে এসে পা থামল, সেটিও এক কামরার টালির ঘর। কিন্তু, ওই ঘরের কদর এখন পাড়া ছাড়িয়ে আশপাশেও ছড়িয়েছে। সৌজন্যে, পরিবারের বড় মেয়ে সঙ্গীতা দাস। আগামী সাত মাসের জন্য যাঁর ঠিকানা হতে চলেছে ফ্রান্সের আরিয়েজ নদী তীরবর্তী ফোয়া শহর। ইএম বাইপাসের এক দিকে আকাশ দখল করেছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল এবং সারি সারি বহুতল। রাস্তার অন্য দিকে, দত্তাবাদের বরাদ্দ এক ফালি আকাশ। সেই পথেই আগামী সেপ্টেম্বরে কবিতা, ভালবাসা আর সুগন্ধীর দেশে পাড়ি জমাবেন বালির মাঠের বাসিন্দা সঙ্গীতা।
তাঁর অর্জিত পারফর্মিং আর্ট সে দেশের যুবসমাজে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সেখান থেকে সংস্কৃতি বহন করে আনাই সফরের লক্ষ্য। যারা না থাকলে সঙ্গীতার এই জীবন-সফর সম্ভব হত না, ‘প্রয়াসম’ নামক সেই সংস্থার অধীনেই সঙ্গীতার বেড়ে ওঠা। বিভিন্ন দেশের কনসুলেটের সঙ্গে সংস্থার যোগাযোগে প্রায় প্রতি বছরই প্রান্তিক পরিবার থেকে নির্বাচিত ছেলেমেয়েরা এই ধরনের প্রকল্পে জুড়ে থাকার সুবাদে বিদেশে যান। সেখানে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি নতুন জিনিস শিখে এ দেশে তা প্রসারের সুযোগও পান তাঁরা।
সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের এই প্রস্তাব প্রয়াসমের কাছে এসেছিল ফরাসি কনসুলেট থেকে। সঙ্গীতার নাম পাঠিয়েছিল ওই সংস্থা। এ বছর কলকাতা থেকে ফ্রান্সে একমাত্র তিনিই যাচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অবশ্য সেখানে যাচ্ছেন প্রান্তিক পরিবারের মোট ১০ জন তরুণ-তরুণী। পুদুচ্চেরির কনসুলেট অফিস থেকে অনলাইনে ২০ মিনিটের ইন্টারভিউ পর্বের শেষে চূড়ান্ত হয়েছে বছর চব্বিশের সঙ্গীতার নাম। দু’জন ফরাসি এবং এক জন ভারতীয়ের কাছে ইংরেজিতে ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হতে পারাটা সংস্থার ‘অন ট্র্যাক ম্যানেজমেন্ট’-এর তালিমেই সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সঙ্গীতা।
বাবা কলের মিস্ত্রি দেবপ্রসাদ দাস বর্তমানে অসুস্থ হয়ে ঘরবন্দি। মা ভবানী দাস কলেজ মোড়ে হাউসকিপিংয়ের কাজ করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় সঙ্গীতা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে আর পড়তে পারেননি। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে গর্বিত মা হাসিমুখে বলে চলেন, ‘‘ওর যখন ১২-১৩ বছর বয়স, তখন প্রয়াসমে পাঠিয়েছিলাম। ওর বাবাই বলেছিল, ঘরে বসে থেকে কী হবে? বরং বিকেলে ওখানে গেলে ইংরেজি শেখাবে, হাতের কাজ শেখাবে। সেই সিদ্ধান্ত বদলে দিচ্ছে মেয়েটার জীবন। সঙ্গে আমাদেরও। ওর বিয়ের কথা আর ভাবি না। যেমন ভাবে চায়, ও বড় হোক।’’
সংস্থার থেকে ভরতনাট্যম, কুচিপুড়ি, ওড়িশি নাচ শিখেছেন সঙ্গীতা। এ দেশে আসা বিদেশি অতিথির থেকে জ়ুম্বার প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশিক্ষকের শংসাপত্রও পেয়েছেন। শিখেছেন হিপহপ। পুরনো, বাতিল, ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পোশাক এবং গয়না তৈরিতেও নিজের অধ্যবসায়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন সঙ্গীতা। সে সবই স্যেন নদীর দেশে গিয়ে শেখাবেন তিনি।
১৯৯৬ সাল থেকে সল্টলেক, রাজারহাট, নিউ টাউনের প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েদের হাতের কাজ, সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ, ইংরেজি শিক্ষা, সহবতের পাঠ দিয়ে আসছে প্রয়াসম। সংস্থার সভাপতি সপ্তর্ষি রায় বলেন, ‘‘সঙ্গীতার উত্থান আমাদের কাছে গর্বের। আমরা বরাবর মনে করি, সামাজিক যোগ্যতার বিচার আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে হওয়া উচিত নয়, হওয়া উচিত কারও দক্ষতার ভিত্তিতে। সেই জায়গাতেই সঙ্গীতা এগিয়ে রয়েছে সল্টলেকের তথাকথিত উচ্চবিত্ত অনেকের থেকেই। ওর মধ্যে শেখার যে আগুন আছে, সেটা ওকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।’’
এমন সুখবরের মাঝেও অবশ্য মন খারাপ সঙ্গীতার। ২০২০ সালের ২১ মে করোনায় মারা গিয়েছেন তাঁর ঠাকুরমা। যিনি প্রবল ভাবে বিশ্বাস করতেন, তাঁর আদরের পুচুও এক দিন সাগরপারের সাহেবদের কোনও এক দেশে যাবে। মেঘের আড়াল থেকে কি দেখা যায়?