OPD

থিকথিকে ভিড়ে অপেক্ষা অসুস্থের, কখন আসবেন ‘বড় ডাক্তারবাবু’

রোগীরা থাকেন অপেক্ষায়। কিন্তু চিকিৎসকেরা আসেন না সময়ে। সরকারি হাসপাতালের এই হাল ঘুরে দেখল আনন্দবাজার।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৪১
Share:

অপেক্ষা: রোগী ও তাঁদের পরিজনদের ভিড় উপচে পড়ছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

একের পর এক নিয়ম তৈরি হয়, কিন্তু বদলায় না পরিস্থিতি। সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র চিকিৎসকদের সময়ে না আসার বিষয়ে অভিযোগ তুলেছে খোদ ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন’। শহরের মেডিক্যাল কলেজগুলিকে এনএমসি-র তরফে রীতিমতো শো-কজ়ও করা হয়েছে। তবু, চিত্রের কোনও বদল নেই। বরং সব ‘অনিয়ম’ই চলছে নিজের ছন্দে।

Advertisement

নিয়ম মেনে সকাল ৯টায় বহির্বিভাগে ডাক্তারদের না আসার অভিযোগে কমবেশি বিদ্ধ শহরের প্রায় সমস্ত মেডিক্যাল কলেজই। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের পরে শুক্রবার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘুরে দেখা গেল, সেখানেও নির্দিষ্ট সময়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসকেরা আসেন না। কয়েকটি বিভাগে হাতে গোনা এক-দু’জন থাকলেও তাঁদের বয়স দেখে সিনিয়র চিকিৎসক বলে মনে হল না। আর রোগীর সংখ্যার নিরিখে চিকিৎসকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। আর জি করের তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ হাতে রয়েছে চারতলা বহির্বিভাগ ভবন। সকাল ৯টাতেই যার প্রতিটি তলা কার্যত জনসমুদ্র। ‘‘১০টা-সাড়ে ১০টার আগে বড় ডাক্তারবাবুরা আসেন না’’— এই বলে নতুন রোগীদের আশ্বস্ত করতে দেখা গেল পুরনোদের। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ওই রোগীদের এ-ও বলতে শোনা গেল, ‘‘ডাক্তারবাবুরা একটু তাড়াতাড়ি এলে আমরাও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারি।’’ জেনারেল মেডিসিন, কার্ডিয়ো থোরাসিক অ্যান্ড ভাস্কুলার সার্জারি (সিটিভিএস), অস্থি, শল্য, ডায়াবিটিস থেকে শুরু করে বহির্বিভাগে রক্ত সংগ্রহ কেন্দ্র, কোথাওই সকাল সাড়ে ৯টায় সে ভাবে চিকিৎসকদের দেখা মেলেনি। যদিও আর জি করের এক কর্তার দাবি, ‘‘ইন্টার্ন বা আরএমও, কেউ না কেউ সাড়ে ৯টার মধ্যে গিয়ে কাজ শুরু করে দেন। সিনিয়রদের তো ভর্তি রোগীদেরও দেখতে হয়। তাই তাঁদের যেতে একটু দেরি হয়। সব থেকে বড় কথা হল, চিকিৎসকের সংখ্যাই তো কম। অস্থি, মেডিসিন, শল্য, সিটিভিএস-সহ বেশ কয়েকটি বিভাগে মেরেকেটে দু’-চার জন করে সিনিয়র রেসিডেন্ট রয়েছেন।’’

যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ঠিক সময়ে যাচ্ছেন না কেন? সাড়ে ৯টা পেরিয়ে প্রায় ১০টা বেজে যাচ্ছে, তবু কেন বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না? আর জি করের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, চিকিৎসক-বিধায়ক সুদীপ্ত রায় বললেন, ‘‘সকাল ৯টাতেই বহির্বিভাগ চালুর জন্য সকলকে বলা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগের ইউনিট প্রধানদের নিয়ে বৈঠকে বসব। আগামী ৮ নভেম্বর শল্য বিভাগের ৬ জন ইউনিট হেডের সঙ্গে কথা বলব। ঠিক সময়ে উপস্থিত না হলে এ বার থেকে অধ্যক্ষের অফিসে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে।’’

Advertisement

এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ বহির্বিভাগের একতলায় অস্থি বিভাগের ১০৬-এফ নম্বর ঘরে গিয়ে দেখা গেল, কম বয়সি তিন জন চিকিৎসক বসে রয়েছেন। পাশের ১০৬-ই নম্বর ঘর ফাঁকা। তার সামনে অপেক্ষারত রোগীদের কেউ স্ট্রেচারে শুয়ে, কেউ আবার বসে রয়েছেন। তাঁদেরই এক জন জানালেন, ১০৬-এফ ঘর থেকে প্রয়োজন মতো রোগীদের রেফার করা হয় ১০৬-ই নম্বর ঘরে। আর, পুরনো টিকিটের রোগীদেরও সেখানে দেখা হয়। এক রোগীর কথায়, ‘‘মুখেই বলে সকাল ৯টায় শুরু হবে। কিন্তু বড় ডাক্তারেরা ১০টার আগে আসেন না।’’ সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে দোতলায় জেনারেল মেডিসিনের ২০১ নম্বর ঘরের সামনে বারান্দায় থিকথিক করছে রোগীর ভিড়। ভিতরে ছ’টি কেবিনের মাত্র দু’টিতে ডাক্তার বসেছেন। মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান রামতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, সিনিয়র চিকিৎসকের অভাব রয়েছে তাঁর বিভাগে। তিন জন প্রফেসরের মধ্যে এক জন কয়েক মাস পরেই অবসর নেবেন। আর এক জন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং চার জন এসআর রয়েছেন। রামতনু বলেন, ‘‘তা-ও আরএমও বা ইন্টার্নেরা সকালেই গিয়ে কাজ শুরু করে দেন। ভর্তি থাকা রোগীদের দেখে আমরা যাই।’’

উল্টো দিকে, ২০৬ নম্বর ঘরে রয়েছে ডায়াবিটিস ক্লিনিক। সেখানে কখন চিকিৎসক আসবেন, জানা নেই কারও। বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতে দেখা গেল অনেককেই। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন গর্ভবতীও রয়েছেন। কর্তৃপক্ষের দাবি, আর জি করে নির্দিষ্ট কোনও এন্ডোক্রিনোলজিস্ট নেই। মেডিসিনের এক জন ‘ডিএম’ পাশ করা চিকিৎসকই বিভাগটি সামলান। চারতলা থেকে একটি লাইন সিঁড়ি দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে দোতলার রক্ত সংগ্রহের ঘর পর্যন্ত। সেখানে দাঁড়ানো এক রোগীর আক্ষেপ, ‘‘পৌনে ১০টা বেজে গেলেও এখনও একটু একটু করে লাইন এগোচ্ছে। এ দিকে, পরীক্ষার জন্য রক্ত না দেওয়া পর্যন্ত খালি পেটে থাকতে হবে।’’ শল্য বিভাগেও সকাল পৌনে ১০টায় মাত্র এক জন চিকিৎসক। সকাল ৯টায় বহির্বিভাগ শুরুর কথা থাকলেও ওই সময়ে কেন মাত্র এক জন? শল্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গৌতম ঘোষ অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আবার ৯টা ৫০ মিনিটে সিটিভিএসের ৪০২ নম্বর ঘরে গিয়ে দেখা গেল, একটি কেবিনে জনাকয়েক চিকিৎসক বসে রয়েছেন। তবে, তাঁরা প্রায় সকলেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। বাইরে তখন রোগীদের ভিড় জমছে। তাঁরাই জানালেন, পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখে শুধু ওষুধ লিখে দেওয়ার জন্য ওই জুনিয়র চিকিৎসকেরা রয়েছেন। সিনিয়রদের দেখাতে গেলে অপেক্ষা করতে হয়। (চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement