বার্তা: বাগুইআটির জ্যাংড়ায় এই ভাবেই পশুহত্যা বিরোধী থিমে সাজিয়ে তোলা হয়েছে একটি গোটা বাড়ি। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
বাড়ির বাইরের দেওয়ালে আঁকা এক নারীর প্রতিকৃতি। তাঁর এক কোলে শিশুপুত্র, অন্য কোলে একটি কুকুরছানা। পাশেই রয়েছে কয়েকটি ব্যাঙের ছাতা। তার গায়ে লেখা,
‘ওল্ড এজ হোম’। তারই পাশে ঘুমন্ত কুকুরের গায়ে গরম জল ঢালার দৃশ্য। সেখানে লেখা, ‘গরম জল যা, গরম চা-ও তাই’। একটি কুকুর চওড়া রাস্তা পারাপার করছে, পিছনে একাধিক গাড়ির ভিড়। আমার আপনার একটু সর্তকতা, একটু সহমর্মিতা ওদের সুস্থ ভাবে বাঁচতে সাহায্য করবে।
এমনই বার্তা দিতে সেজে উঠেছে বাগুইআটির জ্যাংড়া ঘোষপাড়ার রুমনা দাসের বাড়ি।
এর আগে প্রিয় দলের জার্সির রঙে সেজে ওঠা বাড়ি কিংবা ‘সবুজ বাঁচাও’ আবেদনে বাড়ির বহিরঙ্গের সাজ দেখা গিয়েছে এ শহরে। কিন্তু পশুহত্যা বিরোধী ভাবনা নিয়ে সাজিয়ে তোলা এ বাড়ি যেন অন্য শহরের কথা বলে। যার ভৌগোলিক অবস্থান কুকুরছানা পিটিয়ে খবরের শিরোনামে ওঠা শহরের সঙ্গে এক বিন্দুতে থাকলেও মানবিকতার আদর্শ অনুপ্রেরণা দিতেই পারে অন্যদের।
পোষ্যদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগ পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী রুমনার। ২০০৫ সালে তমালকান্তি দাসের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। কাঁকুড়গাছির বাপের বাড়িতে থাকাকালীন রুমনার বাবা একটি অ্যালসেশিয়ান নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ভয়ের চোটে তখন তিনি কুকুরের কাছে ঘেঁষতেন না। পরে নিজেই পশু হাসপাতাল থেকে একটি দেশি কুকুর বাড়ি নিয়ে আসেন রুমনা। নাম রাখেন রানু। এর পর থেকেই কুকুরদের সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরু। রুমনা বলে চলেন, “এখন বাড়িতে রানুর বংশধর সোনু এবং তার সন্তান ভালু রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে রাজা এবং রানি। আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল বলে দারোয়ান রাজাকে খুব মারধর করেছিল। মৃতপ্রায় রাজাকে ঘরে নিয়ে এসেছিলাম।”
ওদের ভালবাসা থেকেই রুমনারা স্থির করে ফেলেছিলেন, নিজের ছেলে হলে নাম রাখবেন রানা, মেয়ে হলে রানু। রুমনার মতে, “শিশুর শিক্ষার শুরু হয় তার বাড়ি থেকেই। আমার সন্তানদের জন্য তো বটেই, প্রতিবেশী এবং পথচারীদের বিশেষ বার্তা দিতেই বাড়িটাকে এমন ভাবে সাজিয়েছি আমরা।”
শুধু বাড়ির বাইরেই নয়, রুমনাদের শোয়ার ঘরের দেওয়ালে আঁকা রয়েছে কুকুরদের সঙ্গে তাঁদের ছেলের ছবি। ঠিক যেন ‘জঙ্গল বুক’ সিনেমার দৃশ্য। বসার ঘরের এক দিকের দেওয়ালে একটি গাছ আঁকা। তার ডালপালায় আঁকা পশু অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের কর্মী দেবশ্রী রায়, লিলি চক্রবর্তী, আলপনা গোস্বামীর মতো পরিচিত মুখ। রুমনার কথায়, “এটিই আমাদের বৃহত্তর পরিবার।” এর পাশের দেওয়ালে বেশ কয়েকটি কুকুরের পায়ের ছাপ রয়েছে। তার প্রতিটিতে রয়েছে রুমনার নিজের পোষ্যদের ছবি। নিজের সন্তান আর কুকুরছানার মধ্যে ফারাক না করা রুমনা ফিরে গেলেন রানুর কথায়। বলেন, “জানেন, আমার কোলে মারা গিয়েছিল ও। ওর সন্তান সোনু যে ভাবে ওর মৃত মাকে সে দিন ডাকছিল, কোনও দিন তা ভুলতে পারব না।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে চোখে পড়ল, দু’টি কাঠের দরজার একটিতে কুকুরছানার এবং অন্যটিতে এক শিশুর পায়ের ছাপ খোদাই করা। মনে পড়ল রুমনার কথা― এ বাড়ি যতটা মানুষের, ততটাই ওদেরও।