২৬৬ বিঘা জমিতে ৬০০টি প্লট দিয়ে শুরু হয়েছিল দমদম পার্কের কলোনি। — ফাইল চিত্র।
দেশভাগের পরে দমদম এলাকায় একের পর এক উদ্বাস্তু কলোনি তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যাঁরা উল্টোডাঙায় থিতু হলেন, তাঁদের
চিন্তাভাবনা ছিল অন্য রকম। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জন ছিলেন আইনজীবী। তাঁরা চেয়েছিলেন, একটি কো-অপারেটিভ গঠন করে সরকারের কাছ থেকে জমি কিনে আইনসিদ্ধ কলোনি তৈরি করতে। কিন্তু কোথায় তৈরি হবে সেই কলোনি?
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে একটা নিচু জমি পাওয়া গেল বাগজোলা খাল ও ক্যান্টনমেন্ট খালের কাছে। নামেই জমি। প্রায় পুরোটাই হোগলা বন আর কচুরিপানায় ভর্তি। প্রথম বার দেখে মনে হয়েছিল, ওখানে বসবাসের জন্য বসতবাড়ি তৈরি করা কার্যত অসম্ভব। কিন্তু অসম্ভবকেই চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিলেন তাঁরা। ওই জমিতেই বসতি স্থাপন করতে তৈরি করলেন ‘কৃষ্ণপুর রেফিউজি অপারেটিভ কলোনি লিমিটেড’।
এই কৃষ্ণপুর রেফিউজি অপারেটিভ কলোনিই আজকের দমদম পার্ক। চলতি বছরে ‘কৃষ্ণপুর রেফিউজি কো-অপারেটিভ কলোনি লিমিটেড’ ৭৫তম বর্ষ পূরণ করছে। এই উপলক্ষে সোসাইটির সম্পাদক রণেন্দ্রমোহন রায় বলেন, ‘‘৭৫ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সমবায় সমিতি তৈরি করে সেখানে বসতি স্থাপনের যে নিদর্শন তৈরি করেছিলেন, তা পশ্চিমবঙ্গে নজিরবিহীন ছিল। ২৬৬ বিঘা জমিতে ৬০০টি প্লট দিয়ে শুরু হয়েছিল কলোনি। এমন করে রাস্তা তৈরি হয়েছিল যে, ব্লাইন্ড লেন বলে কিছু নেই। এলাকায় অনেক গাছ লাগানো হয়। এর ফলে প্রচুর পাখি আসতে শুরু করে। এই পরিবেশ পরবর্তী প্রজন্মও রক্ষা করে চলেছি।’’
দমদম পার্কের উপরে গবেষণা করছেন মৌমিতা সাহা এবং শ্যামল ঘোষ। মৌমিতা বলেন, ‘‘কো-অপারেটিভ সোসাইটি জমি উন্নয়নের সময়ে কাঠাপিছু দাম রেখেছিল ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। ঠিক তখনই তৈরি হচ্ছিল লেক টাউন, বাঙুর। লেক টাউন, বাঙুরে কিন্তু তখন জমির দাম ছিল কাঠাপিছু ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। তখনকার দিনে এত টাকা দিয়ে সবার পক্ষে জমি কেনা সম্ভব ছিল না। ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষদের কাছে বসতবাড়ি তৈরির জন্য তখন দমদম পার্কই ছিল সহায়।’’
শুধু জমি বিলি করাই নয়, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে নিকাশি নালা তৈরির কাজে হাত লাগায় এই সোসাইটি। এমনকি নিচু জমি ভরাট করার জন্য মাটি খুঁড়ে পাঁচটা দিঘিও কেটেছিলেন তাঁরা। শ্যামল বলেন, ‘‘ওই পাঁচটা দিঘি এখনও দমদম পার্কের সম্পদ। তখন দমদম পার্কের বাড়িগুলি দিঘির দিকে মুখ করে তৈরি হয়েছিল। দিঘিকে ঘিরে করা হল বৃক্ষরোপণ। জলাশয় বুজিয়ে বহুতল তৈরির ঘটনা তো হামেশাই শোনা যায়। দমদম পার্ক ছিল তার ব্যতিক্রম। এখনও দিঘিগুলিকে যত্ন করে রাখা হয়। সেখানে মাছ চাষ হয়।’’
সোসাইটির প্রেসিডেন্ট স্বপনকুমার ঘোষ বলেন, ‘‘কৃষ্ণপুর রেফিউজি কো-অপারেটিভ কলোনি লিমিটেডের রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে। প্রথমে অফিস ছিল উল্টোডাঙা মেন রোডে। পরে তা দমদম পার্কে চলে আসে। পুকুর খনন,
গাছ লাগানো ছাড়াও সমিতির উদ্যোগে এখানে ছেলে ও মেয়েদের দু’টি হাইস্কুল, কিন্ডারগার্টেন স্কুল তৈরি হয়। পরে অবশ্য হাইস্কুল দু’টি সরকার পোষিত হয়েছে।’’ এখন দমদম পার্ক দক্ষিণ দমদম পুরসভার অন্তর্গত। তবে কৃষ্ণপুর রেফিউজি কো-অপারেটিভ কলোনি লিমিটেডও সমান সক্রিয়।
মৌমিতা জানান, ২০২৫ সাল আন্তর্জাতিক সমবায় বর্ষ। এর আগে দমদম পার্কের সমবায় সাফল্য একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই প্রজন্ম সেই সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। দমদম পার্কের ৭৫ বছর পূর্তিতে ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর হবে নানা অনুষ্ঠান।