অসহায়: পা ভাঙা ছেলেকে কোলে নিয়েই ভোগান্তির শিকার সুব্রত কুণ্ডু। বৃহস্পতিবার, শিয়ালদহ স্টেশনে। নিজস্ব চিত্র।
দু’পা ভাঙা ছেলেকে নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের কিছুটা দূরে ঠায় বসে বাবা। সমাবেশে যোগ দিতে আসা, স্রোতের মতো ভিড় ঠেলে ছেলেকে নিয়ে কী ভাবে স্টেশনে ঢুকবেন, সেটাই ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। মিনিট পনেরো বসে থাকার পর ফের ছেলেকে কোলে নিয়ে, আধ ঘণ্টা ধরে ভিড় ঠেলে স্টেশনের বাইরে অস্থায়ী পুলিশ সহায়তা কেন্দ্র ছুঁয়ে যত ক্ষণে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলেন, তত ক্ষণে বাড়ির ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে। ঘণ্টাখানেক পরের ট্রেনেও অসুস্থ ছেলের জন্য আদৌ কোনও জায়গা মিলবে কি না, সেটাই ভাবাচ্ছে উদ্বিগ্ন বাবাকে।
বৃহস্পতিবার একুশে জুলাইয়ের ভিড়ে শুধু শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরই নয়, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে এটাই ছিল ভোগান্তির চেনা দৃশ্য। ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে এসে হাওড়া স্টেশনে গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা কিংবা হাজরা মোড়ে গাড়ি না পেয়ে অসুস্থ ছেলেকে কোলেনিয়ে মায়ের অঝোরে কান্না— এমন টুকরো টুকরো ছবি দেখা গিয়েছে শহরের সর্বত্র। ফলে পথে বেরোনো নিরুপায় জনতার প্রশ্ন, ‘‘এমন বিশেষ দিনে আপৎকালীন রোগীদের জন্য সুব্যবস্থা থাকবে না কেন?’’
এ দিন ভোগান্তির শিকার অশোকনগরের বাসিন্দা, বছর সাতেকের জিৎ কুণ্ডুর পা ভেঙেছিল মাস দুই আগে। বাঁ পায়ের পাশাপাশি কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল ডান পা-ও। আগে এন আর এসে প্লাস্টার করা হলেও বৃহস্পতিবার ছিল হাসপাতালের বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখানোর দিন। বালকের বাবা সুব্রত কুণ্ডু বলেন, ‘‘গাড়ি করে আসব ঠিক ছিল। দিন দুই আগে ২১ জুলাই কলকাতা যেতে হবে শুনে না বলে দেন গাড়িচালক।’’ বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়ে ভোর ৫টায় ট্রেনে চাপেন। সকাল ৭টা নাগাদ শিয়ালদহে নেমে এন আর এসে পৌঁছে গেলেও ফেরার সময়ে হয় ভোগান্তি। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলে তো পা ভাঁজও করতে পারে না। সোজা করে রাখে। ওই ভিড় ঠেলে ওকে কোলে নিয়ে কী আসা যায়! শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি ওর পায়ে লাগল।’’
গাড়ি না পেয়ে হাজরা মোড়ে এদিন একই রকম ভোগান্তির মুখে পড়েন এক দম্পতি। বিহারের বাসিন্দা রাধা ও তাঁর স্বামী তাঁদের দেড় বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত সেই শিশুকে কিছু দিন অন্তর রক্ত দিতে হয়। সে জন্য দিন কয়েক আগে শহরে এসে নরেন্দ্রপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন তাঁরা। গত মঙ্গলবার মেয়েকে নিয়ে যান চিত্তরঞ্জন শিশুসদন হাসপাতালে। সেখান থেকে এ দিন সকালেই মেয়েকে ছাড়া হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েই তাঁরা পড়ে যান সমাবেশের জনসমুদ্রের মধ্যে। হাজরা মোড়ের কাছে ওই হাসপাতালের সামনের রাস্তায় যান চলাচল তখন মিছিলের চাপে বন্ধ। রাধার স্বামী কমলেশ বলেন, ‘‘নরেন্দ্রপুর কী ভাবে যাব তা-ই বুঝতে পারছি না। পুলিশও একটা বাস ধরিয়ে দিতে পারছে না। আজই সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে আমাদের বিহারের ট্রেন ধরার কথা। এমন মিছিল কোনও দিন দেখিনি।’’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য হাসপাতাল চত্বরেই কিছুটা সময় কাটিয়ে, ভিড়ের চাপ খানিকটা কমলে বাস ধরে নরেন্দ্রপুরে ফেরেন তাঁরা।
অসুস্থ ছেলে ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে ধানবাদ থেকে কলকাতায় শিশুমঙ্গল হাসপাতালে এসেছিলেন সুমিতা মুখোপাধ্যায়। সকাল ৮টায় তৃণমূল সমর্থকদের ভিড়ে ঠাসা কোলফিল্ড এক্সপ্রেসে করে হাওড়ায় নামেন সুমিতারা। তার পরে অসুস্থ ছেলে ও বৃদ্ধা বাবা-মাকে নিয়ে স্টেশনের বাইরেপ্রি-পেড ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেই ঠায় বসে দুপুর ২টো পর্যন্ত!
সুমিতা বলেন, ‘‘আজই ছেলেকে দেখানোর সময় দিয়েছিল হাসপাতাল। সমাবেশের কথা জানা সত্ত্বেও তাই বাধ্য হয়ে এমন দিনে কলকাতায় এসেছি। ট্রেনের মধ্যেই মিছিলকারীদের প্রবল ভিড়ে ছেলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। খিঁচুনি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কোনও মতে সামলে হাওড়ায় এসে ভেবেছিলাম, বাগবাজারে আত্মীয়ের বাড়ি চলে যাব। কিন্তু একটাও ট্যাক্সি নেই। অসহায় অবস্থায় প্রায় ছ’ঘণ্টা ধরে বসে রয়েছি।’’ অসুস্থ ছেলে-কোলে বসেমিছিল শেষের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছেন সুমিতা। বললেন, ‘‘কার কাছে সাহায্য চাইব? সকলেই তো মিছিল নিয়ে ব্যস্ত।’’