‘ভাল’ রাস্তা সারাতেও দুশো কোটি!

আপাতদৃষ্টিতে কলকাতার রাস্তাঘাট ‘ভাল’ বলেই মত পুরসভার। দু’চারটি রাস্তার কিছু জায়গায় অল্পবিস্তর খানা-খন্দ থাকলেও পুর-কর্তৃপক্ষের মতে তা বিশেষ সমস্যার নয়। তবে এ সব সত্ত্বেও ফি বছর শহরে রাস্তা সারাইয়ের জন্য খরচ হচ্ছে ২০০ কোটিরও বেশি টাকা।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০০
Share:

আপাতদৃষ্টিতে কলকাতার রাস্তাঘাট ‘ভাল’ বলেই মত পুরসভার। দু’চারটি রাস্তার কিছু জায়গায় অল্পবিস্তর খানা-খন্দ থাকলেও পুর-কর্তৃপক্ষের মতে তা বিশেষ সমস্যার নয়। তবে এ সব সত্ত্বেও ফি বছর শহরে রাস্তা সারাইয়ের জন্য খরচ হচ্ছে ২০০ কোটিরও বেশি টাকা। একই রাস্তা সারাই হচ্ছে বার বার। পুরসভা সূত্রে খবর, গত ৫ বছরে (২০১০-২০১৫) শুধুমাত্র এই কাজেই এক হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছে পুর-প্রশাসন। কিন্তু প্রতি বছর শহরের এই ‘ভাল’ রাস্তাগুলির পিছনে কোটি কোটি টাকা খরচ কতটা যুক্তিযুক্ত, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে। এমনকী বার বার একই রাস্তা সারাইয়ের পিছনে একটি চক্র কাজ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

কলকাতা পুরসভার অধীনে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার সংখ্যা গোটা পঞ্চাশেক। যার মধ্যে রয়েছে জওহরলাল নেহরু রোড, মহাত্মা গাঁধী রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শরৎ বসু রোড, বিধান সরণি, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোড, মানিকতলা মেন রোড, বেলেঘাটা মেন রোড, উল্টোডাঙা মেন রোডের মতো রাস্তা। আর ছোট রাস্তা, গলি, তস্য গলি নিয়ে সংখ্যাটা পাঁচশো ছাড়িয়ে যাবে। জানা গিয়েছে, রাস্তা সারাইয়ের জন্য বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয় বড় রাস্তার জন্যই। পুরসভার একাধিক ইঞ্জিনিয়ার জানান, এর প্রায় সব ক’টিই ম্যাস্টিকে তৈরি। তাঁদের ব্যাখ্যা, এক বর্গমিটার রাস্তা অ্যাসফাল্টামে করতে খরচ প্রায় ৫০০ টাকা আর ম্যাস্টিকে করতে লাগে প্রায় ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ দশ গুণেরও বেশি। আর ম্যাস্টিকে তৈরি এই রাস্তাগুলির আয়ু ৬-৭ বছর বলে জানিয়েছেন তাঁরা। ওই সময়ের মধ্যে কোথাও কাটাকাটি না হলে রাস্তা খারাপ হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি বছর ২০০ কোটিরও বেশি টাকা খরচ হচ্ছে কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পুরসভার আধিকারিকেরাই। কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায়ের আবার অভিযোগ, ‘‘রাস্তা সারাইয়ের নামে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হচ্ছে। একই রাস্তায় একাধিক বার খরচ করা হচ্ছে। চুরি হচ্ছে রাস্তা তৈরির সরঞ্জামও।’’

পুরসভার রাস্তা দফতরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, শহরের অনেক রাস্তা রয়েছে, যা নানা প্রয়োজনে খোঁড়া হয়। কখনও বিদ্যুতের তার, কখনও জলের লাইন, কখনও বা টেলিকম পরিষেবার কেব্‌ল বসানোর জন্য মাটির নীচে গর্ত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এ জন্য ম্যাস্টিকের রাস্তাও খুঁড়ে ফেলা হচ্ছে অহরহ। ওই রাস্তা শক্তপোক্ত হলেও বার বার গর্ত করার ফলে তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেগুলি। যত দিন টেকার কথা, ততদিন থাকছে না। ফলে প্রায় প্রতিবছরই রাস্তা সারাতে হয়। তবে এ কথা মানতে নারাজ পুরসভার একাধিক মেয়র পারিষদ। তাঁদের কথায়, একটা চক্র কাজ করছে পুরো প্রক্রিয়ায়।

Advertisement

তাঁদের ব্যাখ্যা, খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে ঠিকই, তবে গলদ রয়েছে তা সারাইয়ের ক্ষেত্রে। ম্যাস্টিকের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি হলে তা সারাই করতে হয় সতর্কতার সঙ্গে। যেটুকু অংশ খোঁড়া হয়েছে, কেবল সেই অংশই নয়, তার বাইরেও অনেকটা এলাকা জুড়ে ম্যাস্টিক দিয়েই সারাই দরকার। এতে হয়তো খরচ কিছুটা বেশি হয়, কিন্তু স্থায়িত্ব বাড়ে। কলকাতা পুরসভার রাস্তা সারাইয়ে অবশ্য এই পদ্ধতি মানা হয় না। যেটুকু অংশ খোঁড়া হয়, কেবল তার চারপাশে কিছু জায়গা জুড়ে পিচের বা ম্যাস্টিকের প্রলেপ দেওয়া হয়। বৃষ্টি হলে বা জল পড়লে তা ওই প্রলেপের ফাঁক গলে পুরো রাস্তার ম্যাস্টিক চাদরের তলায় জমে যায়।

এক মেয়র পারিষদের কথায়, ম্যাস্টিকের রাস্তা যত দ্রুত খারাপ হবে, তত বার তা সারাইয়ের জন্য টাকা বরাদ্দ হবে। এ জন্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বদলে অল্প তাপ্পি মারার রেওয়াজ রয়েছে পুরসভায়। তাতে রাস্তার আয়ু হয়তো কমে, তবে আয় বাড়ে অনেকের। আর ওই রেওয়াজ বন্ধে এক শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ার এবং পুরকর্তাদের তেমন আগ্রহ নেই বলেই মত অনেকের।

পুরসভার রাস্তা দফতরের বর্তমান মেয়র পারিষদ রতন দে অবশ্য জানান, তাঁর সময়ে গত এক বছরে বড় রাস্তার জন্য খরচ হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ‘‘গত বার এই পদে এসেছি। আগে কী হয়েছে বলতে পারব না। আমার লক্ষ্য, একটা রাস্তা সারাই হলে তা যেন কমপক্ষে ৩ বছর ভাল থাকে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement