বঙ্গ রাজনীতিতে বহাল ‘টাচ’ বিতর্ক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বুধবার সকাল থেকে ফোন বন্ধ কলকাতা পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর ক্রিস্টিনা মেরির। সম্ভবত মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকেই। কারণ, তিনি প্রচারের আড়ালে রয়েছেন। কারণ, তখন থেকেই তিনি একটি বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছেন। তবে তাঁর সতীর্থরা স্পষ্ট বলছেন, ‘মেরি ম্যাডাম’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে গ্রেফতারের সময় স্পর্শ করে কোনও অন্যায় করেননি।
যদিও গেরুয়া শিবির মনে করছে, ঘোর ‘অন্যায়’ করেছেন ক্রিস্টিনা। শুধু তা-ই নয়, বিজেপির দাবি, শুভেন্দুকে শ্লীলতাহানির মামলায় ‘ফাঁসানোর’ ছক কষেছিল কলকাতা পুলিশ। এমন দাবি করছেন এখন বিজেপি নেত্রী তথা প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষও।
কী ঘটেছিল মঙ্গলবার বিজেপির নবান্ন অভিযানে? সাঁতরাগাছি যাওয়ার পথে শুভেন্দুর গাড়ি পুলিশ আটকে দেয় কলকাতা রেসকোর্সের কাছে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের সামনে। সেখান থেকে অনতিদূরেই নবান্ন। তাই ঘোষিত ‘নবান্ন অভিযান’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে যাওয়াতেই শুভেন্দুকে বাধা দেয় পুলিশ। তখন বিরোধী দলনেতার সঙ্গে ছিলেন বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় এবং বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও।
বিশাল পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ডিসি সাউথ আকাশ মেঘারিয়া। তাঁর বাহিনীতেই ছিলেন ক্রিস্টিনা। সহকর্মীদের পুলিশদের কাছে যিনি ‘মেরি ম্যাডাম’ বলে পরিচিত। শুভেন্দু যখন রাস্তায় ব্যারিকেড ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন, তখন ক্রিস্টিনাই ছিলেন শুভেন্দুর পাশে। তখনই বিরোধী দলনেতা চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, ‘‘আমার গায়ে হাত দেবেন না। গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?’’ পুলিশকর্তাদের ডাকতে বলেন শুভেন্দু। ঠেলাঠেলি এড়িয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন মেঘারিয়া। শুভেন্দু তাঁকে বলেন, ‘‘আপনার লেডি পুলিশ আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?’’ মেঘারিয়া পাল্টা বলেন, ‘‘পুলিশ তো পুলিশই! তার আবার মহিলা-পুরুষ কী!’’ এর পরেও শুভেন্দু ইংরেজিতে বলতে থাকেন, ‘‘ডোন্ট টাচ মাই বডি! আই অ্যাম মেল! জেন্টস পুলিশ ডাকুন।’’
তার পরে শুভেন্দুকে পুরুষ পুলিশকর্মীদের বেষ্টনীতে নিয়ে গিয়ে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। সেই ভ্যানে আগেই তোলা হয়েছিল রাহুলকে। অন্য একটি প্রিজন ভ্যানে তোলায় হয় লকেটকে। তাঁদের সকলকেই লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় তাঁরা ছাড়া পান।
কিন্তু মঙ্গলবার দিনভর রাজ্য রাজনীতিতে শুভেন্দুর ‘ডোন্ট টাচ মাই বডি’ সংলাপ উত্তাপ ছড়ায়। বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য দাবি করেন, ‘‘মহিলা পুলিশকর্মীদের দিয়ে যে ভাবে বিরোধী দলনেতাকে হেনস্থা করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন।’’ অন্য দিকে শাসক তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘‘এ তো ‘সপ্তপদী’ ফিরে দেখা!’’ প্রসঙ্গত, জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র ‘সপ্তপদী’-তে রিনা ব্রাউন চরিত্রের অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন নায়ক উত্তমকুমারের (চরিত্রের নাম কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়) উদ্দেশে সংলাপে বলেছিলেন, ‘‘ও যেন আমায় টাচ না করে!’’
শুভেন্দুর সঙ্গে পুলিশের বচসার সেই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। কিন্তু সেই বিতর্ক থেকে অনেক দূরে ‘মেরি ম্যাডাম’। ডিসি সাউথের স্পেশাল ফোর্সে কর্মরত মেরির সহকর্মীরা বুধবার জানান, ‘উপরতলার’ নির্দেশেই এ নিয়ে কেউ কোনও কথা বলতে পারবেন না। সেই কারণেই ফোন বন্ধ রেখেছেন মেরি। একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, ‘‘মেরি ম্যাডাম কোনও ভুল করেননি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার সময়ে কে নারী, কে পুরুষ এই ভাগ করা উচিত নয়। নিয়ম অনুযায়ী কোনও মহিলার গায়ে পুরুষ পুলিশকর্মী হাত লাগাতে পারেন না। কিন্তু আইনের কোথাও বলা নেই যে, কোনও পুরুষকে আটক করার সময়ে লেডি পুলিশ এগিয়ে যেতে পারবেন না।’’
তবে এই নীতি মানতে নারাজ বিজেপি নেত্রী তথা প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী। একদা এই রাজ্যে পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতী বলেন, ‘‘কার কী করা উচিত, সেটা জানার জন্য আইন কেন তৈরি হয়েছিল, সেটা সবচেয়ে আগে ভাবা উচিত। মহিলা পুলিশবাহিনী যখন তৈরি করা হয়েছিল, তখন তার উদ্দেশ্য ছিল অভিযুক্ত বা বিপদে-পড়া মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়া। কোনও ধর্ষিতার জবানবন্দি নেওয়ার ক্ষেত্রে সে কারণে মহিলা পুলিশ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেই বাহিনী তৈরির নিয়মে কোথাও বলা নেই যে মহিলা পুলিশ দিয়ে কোনও পুরুষকে হেনস্থা করা যাবে!’’
প্রসঙ্গত, ভারতীয় ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড’-এর ৪৬ (এ) ধারায় মহিলা পুলিশের কাজ ও প্রয়োজন সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সেই আইনের কথা উল্লেখ করে কলকাতা পুলিশের এক অফিসার বুধবার জানিয়েছেন, ‘‘ডিসি সাউথ যে কথা মঙ্গলবার বলেছেন সেটাই ঠিক। লেডি পুলিশ পুরুষ অভিযুক্তকে ধরতে পারবে না বলে কোনও নির্দেশ দেওয়া নেই আইনে।’’ তবে তা নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন ভারতী। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘কোনও উল্লেখ নেই মানেই সেটা আইন নয়। যদি এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, একজন দাগি অপরাধী পালিয়ে যাচ্ছে, তখন পুরুষকেও মহিলা পুলিশ ধরতেই পারেন। কিন্তু মঙ্গলবারের পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল। রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কোনও অপরাধী নন। তিনি রাজ্যের মন্ত্রীর সমমর্যাদার রাজনৈতিক নেতা। তাঁকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদানে বাধা দেওয়ার জন্য এমনটা করা যায় না। আর ওখানে পর্যাপ্ত পুরুষবাহিনী ছিল। তা সত্ত্বেও মহিলাদের এগিয়ে দেওয়ার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতেই পারে।’’
শুভেন্দু ‘ডোন্ট টাচ মি’ বলে পুরুষ পুলিশদের ডাকতে বলেও ঠিকই করেছেন বলে দাবি ভারতীর। তিনি বলেন, ‘‘মহিলা পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি বা ধাক্কাধাক্কির পরিস্থিতি তৈরি হলে উল্টে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনা হত বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধেই। তিনি সেই ফাঁদে পা না-দিয়ে ঠিকই করেছেন।’’