বৃহস্পতিবার কী হয়েছিল, বলছে ছবিই।— ফাইল চিত্র।
মিছিলকারী বাম কর্মী-সমর্থকদের পুলিশ লাঠিপেটা করছে, বৃহস্পতিবার সেই ছবি ধরা পড়েছে একাধিক সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায়। আহতের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যাঁদের এক জন মাথায় গুরুতর চোট নিয়ে ভেন্টিলেশনে রয়েছেন। অথচ শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠক ডেকে লালবাজারের কর্তারা দাবি করলেন, মিছিলে পুলিশ লাঠি চালায়নি! বরং মিছিলকারীরাই পুলিশকে আক্রমণ করেছেন বলে অভিযোগ তাঁদের!
এখানেই শেষ নয়। ‘পুলিশ খুনের’ চেষ্টা-সহ বিভিন্ন অভিযোগে জন্য তিন বাম সমর্থককে বৃহস্পতিবার রাতেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। চন্দন বসাক, অমল পাল ও সৌমেন পাল নামে ওই তিন জনকে এ দিন আদালতে পেশ করে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত নিজেদের হেফাজতেও নিয়ে নিয়েছে তারা। কিন্তু পুলিশের দাবি ঠিক হলে মিছিলের এতগুলো মানুষ জখম হলেন কী করে?
লালবাজারের ব্যাখ্যা, তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়েই ওঁরা আঘাত পেয়েছেন! ‘‘কোথাও দেখিনি, পুলিশের হাতে কেউ আহত হয়েছেন।’’— মন্তব্য ডিসি (সেন্ট্রাল ) বাস্তব বৈদ্যের।
বস্তুত এ প্রসঙ্গে বাম নেতৃত্ব ও সংবাদমাধ্যমের একাংশকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করারও চেষ্টা চালিয়েছে লালবাজার। বাম নেতাদের অভিযোগ, পুলিশের লাঠিতে বিশ্বনাথ কুণ্ডু নামে তাঁদের এক সমর্থক মারাত্মক জখম হয়েছেন। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মাথায় অস্ত্রোপচার হয়েছে, আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি রয়েছেন ভেন্টিলেশনে। এই অভিযোগকে কার্যত মিথ্যে তকমা দিয়ে যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকারের দাবি, ‘‘আমরা ওই হাসপাতাল ও বিশ্বনাথ কুণ্ডুর দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। আমরা জেনেছি, উনি বাড়িতে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন।’’ বিশ্বনাথবাবুর দাদা শম্ভুনাথবাবু যদিও সন্ধ্যায় বলেন, ‘‘পুলিশের লাঠিতেই ভাই জখম হয়েছে।’’ শুক্রবার হেয়ার স্ট্রিট থানায় যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র, যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকার, ডেপুটি কমিশনার (সেন্ট্রাল) বাস্তব বৈদ্যের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করেছেন ট্যাংরা এলাকার সিপিএম নেতা দেবেশ দাস। দেবেশবাবুর অভিযোগ, ওই তিন আইপিএসের নির্দেশেই লাঠিচার্জ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনা নিয়ে পুলিশকে তোপ দেগেছেন সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরে তিনি এ দিন বলেন, ‘‘এ রাজ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। প্রায়ই বাম কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। নবান্ন অভিযানে পুলিশ মেরেছিল, বৃহস্পতিবারও মেরেছে।’’ সীতারামের মিছিলে যাওয়ার পথে ভাঙড়ে একটি বাসের উপরে এ দিন হামলা চালানো হয়েছে বলেও বাম নেতাদের অভিযোগ।
বৃহস্পতিবার মিছিলকারীরা যে পুলিশকে মারধর করেছে, তা এ দিন আদালতকেও জানিয়েছে লালবাজার। যদিও সংবাদমাধ্যমের তোলা ছবি কিন্তু অন্য কথা বলছে। কী রকম?
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মিছিলকারীদের পুলিশই লাঠিপেটা করছে। পুলিশ মার খাচ্ছে, এমন ছবি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘সব কিছুর কি ছবি থাকে?’’ সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছে, দুষ্কৃতীদের কায়দায় মিছিলে আসা গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ভাঙছেন পুলিশকর্মীরা! সেগুলো সত্যি নয়?
এর জবাব অবশ্য মেলেনি। পুলিশকর্তারা শুধু বলেছেন, ‘‘আইন মেনেই পদক্ষেপ করা হয়েছে।’’
পুলিশকে মারধরের অভিযোগের বিরুদ্ধে এ দিন আদালতে সরব হন ধৃতদের কৌঁসুলি তপন ঘোষ। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের এজলাসে তিনি বলেন, পুলিশের উপরে চড়াও হওয়ার কোনও প্রমাণ কোথাও মেলেনি। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ধস্তাধ্বস্তিতে আহত পুলিশকর্মীরা প্রাথমিক চিকিত্সার পরে মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়ে ফের পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। ‘‘তাঁদের আঘাত যে গুরুতর, তার প্রমাণ কোথায়?’’— প্রশ্ন তপনবাবুর। শহরে গোলমালের জেরে পুলিশের তরফে এ হেন ‘ব্যাখ্যা’ নতুন নয়। এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তের অপমৃত্যু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন কিংবা বামেদের নবান্ন অভিযানে লাঠিচার্জের পরেও সাংবাদিক বৈঠক ডেকে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছিল লালবাজার। পুলিশের একাংশ বলছেন, বেগতিক দেখলেই কর্তারা এটা করে থাকেন। লালবাজারের অন্দরের ইঙ্গিত, পরিস্থিতি যে এমন দাঁড়াবে, কর্তারা আগে তার আঁচ পাননি। এ দিন সকালে সংবাদপত্র ও চ্যানেলে প্রতিক্রিয়া দেখেই সাংবাদিক বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত হয়। তার আগে সকালে এ নিয়ে একপ্রস্ত বৈঠকও করেন পুলিশকর্তারা। বৈঠক সেরে সাংবাদিকদের সামনে এসে সুপ্রতিমবাবু বলেন, ‘‘বাইরে থেকে প্রচুর লোক এনে পরিকল্পিত ভাবে গোলমালের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। কখনও ইট, কখনও দলীয় পতাকার লাঠি দিয়ে পুলিশকে পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। সিমেন্টের স্ল্যাব, ইট দিয়েও মারা হয়েছে।’’
লালবাজার-সূত্রের খবর, গোলমাল ঠেকাতে পাল্টা মার দেওয়ার পুলিশি পরিকল্পনাও আগাম ছকে ফেলা হয়েছিল। সেই মতো বৃহস্পতিবার পুলিশকর্মীদের বলা হয় লাঠি-ঢাল-হেলমেটে সজ্জিত হয়ে ডিউটিতে যাওয়ার। সশস্ত্র বাহিনী থেকে বেছে বেছে তরুণ কনস্টেবলদের আনা হয়েছিল, যাঁদের বেশির ভাগ বছর দুয়েক হল চাকরি পেয়েছেন। ‘‘নবান্ন অভিযানে বাম কর্মীদের ইটের ঘায়ে অনেক পুলিশ জখম হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার কেউ কেউ সেই রাগ মিটিয়ে নিয়েছেন।’’— মন্তব্য এক অফিসারের। কিন্তু মিছিল আটকানোর জায়গায় তো ডেপুটি কমিশনার, যুগ্ম-কমিশনারের মতো পদস্থ অফিসারেরা বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন! তাঁদের টপকে নিচুতলা এতটা আগ্রাসী কী ভাবে হল, প্রবীণ অফিসারদের একাংশ সেই প্রশ্ন তুলছেন। পুলিশকর্তাদের অনেকে ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করেছেন, লাঠিচার্জ শুরু হওয়ার পরে পরিস্থিতির রাশ কর্তাদের হাত থেকে কার্যত বেরিয়ে গিয়েছিল।
বৃহস্পতিবার এ-ও দেখা গিয়েছে, মহিলা মিছিলকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন পুরুষ পুলিশকর্মীরা। নবান্ন অভিযানের সময়েও মহিলা পুলিশ ছাড়াই মহিলা মিছিলকারীদের পেটানো হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। যে সম্পর্কে পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ বার কোনও কমিশনের দ্বারস্থ না-হয়ে মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বামফ্রন্ট।
লালবাজারের অবশ্য দাবি, মিছিল সামলাতে পর্যাপ্ত মহিলা পুলিশ রাখা হয়েছিল।
এই সংক্রান্ত আরও খবর
পুলিশ লাঠি মেরেছে, বলেই অজ্ঞান ভাই