ন্যানো হটাতে পুর খেসারত দশ কোটির

সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা ভাঙার খরচ গুনতে হবে কলকাতা পুরসভাকে। যার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:০৫
Share:

মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অনুমোদিত কাগজ।

সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা ভাঙার খরচ গুনতে হবে কলকাতা পুরসভাকে। যার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা।

Advertisement

গত বছর সিঙ্গুরে চাষের জমিতে কারখানা গড়ার বিপক্ষে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্য সরকার ওই মামলা করেছিল উচ্চ আদালতে। তাই সুপ্রিম কোর্টের রায় নিজেদের পক্ষে আসায় দ্রুত ওই কারখানা ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তখনই সরকারের হয়ে কেএমডিএ, এইচআরবিসি, পূর্ত দফতর ওই জমিতে গড়ে ওঠা ন্যানো কারখানা ভাঙার কাজে নেমে পড়ে। যোগ দেয় কলকাতা পুরসভাও। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশে পুরসভার চারটি দফতর ঠিকাদারদের দিয়ে ওই কারখানা ভাঙার কাজ শুরু করে। কাজের শেষে হিসেব করে দেখা গিয়েছে, শুধু পুর প্রশাসনেরই খরচ হয়েছে প্রায় দশ কোটি। ভাঙার কাজ আগেই শেষ হয়েছে। এ বার ঠিকাদারেরা বিল দিতেই অস্বস্তিতে পড়েছে পুর প্রশাসন।

যদিও ওই টাকা যে পুরসভা থেকেই মেটানো হবে, তা কাজ শুরুর আগেই অনুমোদন করে দিয়েছেন মেয়র। তবে বিল জমা পড়ার পরেই শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সর্বশেষ পরিস্থিতি কী, জানি না। খোঁজ নিতে হবে।’’ কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। শহরবাসীর করের টাকা কলকাতার উন্নয়নে খরচ করা যায়। সিঙ্গুরে কারখানা ভাঙার কাজে তা খরচের অধিকার কলকাতা পুরসভার নেই।’’

Advertisement

প্রশ্ন উঠেছে, শহরবাসীর করের টাকায় সিঙ্গুরের ওই কারখানা ভাঙার খরচ মেটানো হবে কেন? এমনিতেই এখন পুরসভার ভাঁড়ারে বেশ
টান। তার উপরে বাড়তি খরচের ভার পড়লে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে, তা আঁচ করে চিন্তিত পুরকর্তারা। তা হলে এই উদ্যোগে আগেই বাধা দেওয়া হয়নি কেন? পুরসভা সূত্রের খবর, সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানা ভাঙার কাজ পুরসভা কেন করবে, তা নিয়ে পুর প্রশাসনেই দ্বিমত ছিল প্রথম দিকে। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আপত্তি তুলেছিল পুরসভার অর্থ দফতর। পুরসভার টাকায় এই ভাঙার কাজ করা যে ঠিক হচ্ছে না, পুর কমিশনারকেও তা জানিয়েও দেয় তারা। পুরসভার এক অফিসার জানান, বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, অর্থ দফতরের মুখ্য অফিসার (সিএমএফএ) পদত্যাগপত্র দেন পুর কমিশনারের কাছে। পরে অবশ্য তা গৃহীত হয়নি। তবে বলা হয়েছিল ভাঙার সিদ্ধান্ত একা পুর প্রশাসনের নয়। পিছনে ছিল খোদ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশও।

পুর নথি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মেয়র পরিষদের বৈঠকে স্বয়ং মেয়র ওই বিষয়টি তোলেন (সুয়ো মটো) এবং অনুমোদনও করে দেন। তাতে বলা হয়েছিল, জরুরি ভিত্তিতে ‘স্পট কোটেশন’ করে ঠিকাদার দিয়ে ভাঙার কাজ করাবে পুরসভা। এবং তার জন্য পুরসভার বিধিসম্মত অনুমোদনের অপেক্ষা করা হয়নি। আর ভাঙাভাঙির জন্য যে টাকা খরচ হবে, তা পুরসভার ভাঁড়ার থেকেই মেটানো হবে— দু পাতার ওই নোটের শেষ অংশে তা বলা হয়েছিল। নীচে স্বাক্ষর ছিল মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের। কার্যত ওই নোটের পরেই কাজ শুরু করতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি ওই সব দফতর। বাধা আসেনি অর্থ দফতরেরও। পুরসভা সূত্রের খবর, রাস্তা, মেকানিক্যাল, কেইআইআইপি এবং পিপিপি— এই চারটি দফতরকে ভাঙার কাজে লাগানো হয়েছিল। সেই কাজে পুরসভার ক্রেন, জেসিবি মেশিন, গ্যাস কাটার-সহ আরও অনেক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ভাঙার সময়ে বলেই দেওয়া হয়েছিল, দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। তাই ঠিকাদারেরা প্রচুর লোকলস্কর লাগিয়েছিলেন।

ভাঙার কাজ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। পুরসভার এক পদস্থ অফিসার জানান, এ বার বিল আসতেই চোখ কপালে উঠেছে পুরকর্তাদের। টাকার জন্য তাগাদা শুরু করে দিয়েছেন ঠিকাদারেরা। অফিসার ও ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশের মতে, নাগরিকদের করের টাকাই পুরসভার প্রধান ভাঁড়ার। তা থেকে জল সরবরাহ, জঞ্জাল অপসারণ, নিকাশি-সহ জনস্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়াই পুরসভার প্রধান কাজ। সেই টাকা সিঙ্গুরের কারখানা ভাঙতে ব্যবহার করা নৈতিক ভাবেও অনুচিত। খোদ পুর মহলের একাংশই যে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারে, তা আঁচ করেই এখনও মেয়র পরিষদের বৈঠকে বিল মিটিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তোলা হয়নি। যদিও একাধিক অফিসার মনে করছেন, বৈঠকে মেয়র নিজেই তা অনুমোদনের প্রস্তাব দেবেন, যাতে কেউ বাধা দেওয়ার সাহস না দেখান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement