৩৮ বছরে পা দিল কলকাতা মেট্রো। রবিবার সুখ-দুঃখ সঙ্গে করে মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে পালিত হল ভারতের প্রথম মেট্রো রেলের জন্মদিন।
১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর এসপ্ল্যানেড থেকে প্রথম যাত্রী নিয়ে শুরু হয়েছিল মেট্রোর পথ চলা। তার পর কেটে গিয়েছে বহু বছর। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বার বার নিজেকে পরিবর্তন করে সমান তালে চলছে মেট্রো।
রবিবার মেট্রো রেলের তরফে বলা হয়, ‘‘আমরা গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বাতানুকূল ছাড়া (নন এসি) মেট্রো পরিষেবা আজ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। হাতে পর্যাপ্ত বাতানুকূল কামরা থাকায় আজকের পরে যাত্রী পরিষেবায় আর কোনও দিন কোনও নন এসি মেট্রো চালানো হবে না! সুড়ঙ্গের মধ্যে নন এসি মেট্রোর সেই গর্জন, ভেতরের সেই স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া আর কখনও আপনাদের সহ্য করতে হবে না! আপনার প্রিয় নন এসি মেট্রো দরজা আর কখনও খুলবে না, আর কখনও মেট্রোর মধ্যে সেই পাখা চলবে না! সব এখন ইতিহাসের পাতায়!’’
দুঃখের খবর, রবিবার থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মেট্রো জানিয়ে দিল, আর কখনও মেট্রোর মধ্যে সেই পাখা চলবে না। পুরনো মেট্রোর সেই রেক এখন ইতিহাসের পাতায়।
বাতানুকূল ছাড়া সাধারণ কামরা নিয়েই দীর্ঘদিন সগর্বে চলেছে কলকাতার মেট্রো। ২০১০-র ৭ অক্টোবর মেট্রোয় প্রথম আসে বাতানুকূল কামরা। তখন সংখ্যাটা ছিল মাত্র দুই। তার পর ধীরে ধীরে সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে এখন মেট্রোর সব কামরাই বাতানুকূলে উত্তীর্ণ হয়েছে। এবং আগামিদিনে তাই-ই বজায় থাকবে বলে জানাচ্ছেন মেট্রো রেলের কর্তারা। দীর্ঘদিন ধরে নন এসি মেট্রো চালাচ্ছেন এমন এক চালকের আক্ষেপ, ‘‘এ বার অলবিদা বলতেই হল!’’
রবিবার মেট্রোর জন্মদিনে একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। নন এসি কামরাতে হয় সেই প্রদর্শনী। সেখানে মেট্রোর ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে মেলে ধরা হয়
কী ভাবে শুরু হয়েছিল মেট্রোর যাত্রাপথ, কেনই বা মেট্রোর প্রয়োজন পড়ল কলকাতাবাসীর, সে সবের উত্তর পাওয়া গেল ওই প্রদর্শনী থেকে।
ব্রিটিশ আমলের পর থেকে কলকাতা শহরের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাটের বিস্তার দরকার ছিল। শহরের সংকীর্ণ এবং কম সংখ্যক রাস্তার জন্য যানজট নিত্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তা থেকে রেহাই পেতে বিকল্প পথের সন্ধান শুরু হয়। আর তখনই স্বাধীনতা ভারতে প্রথম মাটির তলা দিয়ে রেল চালানোর ভাবনা।
তবে ভারতের কাছে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রযুক্তিগত ভাবে ছিল অধরা। মেট্রোর সুড়ঙ্গ তৈরির কাজে সাহায্য চাওয়া হয় জার্মানি, হাঙ্গেরি এবং রাশিয়ার কাছে। তাদের সহায়তায় ট্রেন চালানোর জন্য কলকাতার মাটিতে খনন শুরু হয়।
শুধু এই রেলের জন্য চেন্নাইয়ের ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে বিশেষ কামরা তৈরি করে দুই ভারতীয় সংস্থা। অবশেষে ১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর ভবানীপুর থেকে (এখন নেতাজী ভবন) এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে শুরু হয় মেট্রো। তবে তখন একটি ট্রেনে কোচের সংখ্যা ছিল চার। এখন যা আট হয়েছে।
কলকাতা মেট্রোয় জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিভিন্ন স্মৃতি। ১৯৮৬ সালের ২৮ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মেট্রোয় সফর করেন।
ওই বছরই কলকাতার মেট্রো দেখতে আসেন ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি জৈল সিংহ।
বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় সিনেমা তৈরির ভাবনা নিয়ে মেট্রো পথ ঘুরে দেখেন। এ রকম বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে কলকাতা মেট্রোর সঙ্গে।
এখন কলকাতার উত্তরে দক্ষিণেশ্বর থেকে দক্ষিণে কবি সুভাষ পর্যন্ত চলছে মেট্রো রেল।
এ ছাড়া গত বছর থেকে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর পথ চলাও শুরু হয়েছে। সেক্টর ফাইভ থেকে ফুলবাগান পর্যন্ত চলছে ট্রেন। আগামিদিনে শহর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে মেট্রোর একাধিক প্রকল্প। মেট্রোর এক কর্তা কথায়, ‘‘৩৭ বছর আগে এসপ্ল্যানেড স্টেশনে কলকাতার মানুষ প্রথম পাতাল রেল দেখে। যা ছিল বিস্ময়ের নজির। এখন শহরে জালের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে মেট্রো।’’ সত্যিই তো গর্ব হয়!