নবদ্বীপে সদ্য ‘হেরিটেজ’ তকমা পাওয়া মন্দিরের নাটমঞ্চে আয়োজিত রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় ঠাঁই হল না নজরুলের! ফাইল চিত্র।
নবদ্বীপে সদ্য ‘হেরিটেজ’ তকমা পাওয়া মন্দিরের নাটমঞ্চে আয়োজিত রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় ঠাঁই হল না নজরুলের!
তিনি ভিন্ন ধর্মের লোক। তাই মন্দির কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে খুলে ফেলা হল নজরুল ইসলামের ছবি সংবলিত ব্যানার। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে অবশ্য মন্দিরের তরফে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করা হয়েছে।
রবিবার সন্ধ্যায় নবদ্বীপের রানির ঘাট সংলগ্ন রাধারানি মন্দিরে রবিবার একটি নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান ছিল। আয়োজকেরা জানান, প্রস্তুতি পর্বেই মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁদের ডেকে বলেন, মন্দিরে নজরুলের কোনও ছবি রাখা যাবে না বা মালা দেওয়া যাবে না। আয়োজকেরা সেই শর্ত মেনেই অনুষ্ঠান করেন।
যে নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান ঘিরে এত কাণ্ড তার প্রধান বন্দনা সাহা বলেন, “সে দিন অনুষ্ঠান শুরুর খানিক আগে যখন রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের ছবি দেওয়া ফ্লেক্স মঞ্চে টাঙানো হচ্ছে, তখনই মন্দিরের তরফে আমাকে বলা হয় যে নজরুলের ছবি রাখা যাবে না। তিনি ভিন্ন ধর্মের মানুষ, তাঁর ছবিতে মাল্যদান করা যাবে না।”
তিনি কেন সেই প্রস্তাবে রাজি হলেন? কেন ওই নাটমন্দিরে অনুষ্ঠান বন্ধ করে ফিরে এলেন না? বন্দনার যুক্তি, “আমাদের অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি তখন শেষ। ছোটরা তো অত কিছু বোঝে না। তারা সেজেগুজে তৈরি হয়েছে অনেকক্ষণ। অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য হুগলির বৈদ্যবাটি থেকেও কয়েক জন এসেছিলেন। সব মিলিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে ইচ্ছা থাকলেও অনুষ্ঠান বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।”
মঙ্গলবার এই খবর সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। জাতপাত-ধর্মের বেড়া-ভাঙা ভক্তি আন্দোলনের জনক শ্রীচৈতন্যের শহরে নজরুলকে কার্যত ‘অচ্ছুত’ করার ঘটনা নিয়ে সরব হন বহু জন। তাঁরা মনে করিয়ে দেন, আজীবন জাতধর্মের ঊর্ধ্বে থাকা নজরুলের কলম থেকেই বেরিয়েছে, ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’র মতো ভক্তিগীতি, অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীতও। ধর্মের তকমা দিয়ে তাঁকে ব্রাত্য করা মানতে পারছেন না প্রায় কেউই।
এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেছে বলে মনে করতে পারছেন না শহরের প্রবীণ নাগরিকেরা। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের মতে, “এই ঘটনা নজিরবিহীন। এ শহরে প্রতিটি মসজিদের লাগোয়া মন্দির রয়েছে। এখানে আজ পর্যন্ত কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। এই কাণ্ডকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই দেখতে চাই। এই ঘটনা নবদ্বীপের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়।”
সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত তথা নাট্যব্যক্তিত্ব শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলছেন, “এ সব চরম অজ্ঞতার ফল। নবদ্বীপের সোনার গৌরাঙ্গ মন্দিরে আমরা আজীবন নাটক করেছি। নাটমন্দিরের উদ্দেশ্যই তো গীতাভিনয়। ওঁরা হয়ত জানেনই না যে মন্দিরে যখন ৬৪ মোহান্তের ভোগের আয়োজন হয়, সেখানে মহাপ্রভুর সঙ্গে যবন হরিদাসেরও একটি আসন থাকে।”
এ দিনই রাধারানি মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে নবদ্বীপের সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মীদের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠিতে ভুল স্বীকার করা হয়েছে। কেন তাঁরা এমন ‘ভুল’ করলেন?
রাধারানী মন্দিরের প্রধান মল্লিকা দাসীর দাবি, “বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্ক তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই আমি উদ্যোক্তাদের নজরুলের ছবি সংবলিত ব্যানার সরিয়ে ফেলতে বলেছিলাম। অনুষ্ঠানে নজরুলের গান নিয়ে আমার কোনও আপত্তি ছিল না।” এর পরেই তিনি বলেন, “আমি ভাবিনি যে এটা নিয়ে এই পর্যায়ের বিতর্ক তৈরি হতে পারে। এর জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, দুঃখিত।”
নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। নবদ্বীপে এমন ঘটনা মহাপ্রভুর অপমান। ওঁদের উদ্দেশে একটা কথাই বলার, শ্রীচৈতন্যের জীবনী ভাল ভাবে অনুধাবন করুন।”