বিদ্যুৎহীন হাসপাতালে ক্যাঙারুর মতো কেয়ার নিয়ে শিশুদের বাঁচাল মায়েরা

কম ওজনের সদ্যোজাতদের বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে ‘ক্যাঙারু কেয়ার’ পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিলেন হাসপাতালের সিনিয়র থেকে জুনিয়র চিকিৎসকেরা।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:২২
Share:

এনআরএসের ক্যাঙারু কেয়ার। মঙ্গলবার সাগর দত্ত হাসপাতালে এ ভাবেই রাখা হয়েছিল সদ্যোজাতদের। —নিজস্ব চিত্র।

মায়ের উত্তাপ হারিয়ে দিল বিদ্যুৎ বিপর্যয়কে!

Advertisement

আচমকাই বিদ্যুৎ স‌ংযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার জেরে কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতালে অন্ধকার নেমে আসায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (নিকু) ইনকিউবেটার। সেখানে থাকা কম ওজনের সদ্যোজাতদের বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে ‘ক্যাঙারু কেয়ার’ পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিলেন হাসপাতালের সিনিয়র থেকে জুনিয়র চিকিৎসকেরা।

‘ক্যাঙারু কেয়ার’ অর্থাৎ, মায়ের বুক বা পেটের উপরে শিশুকে রেখে দেওয়ার পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই মানা হয়। শিশুর জন্মের পরেই তাকে তড়িঘড়ি নার্সারিতে পাঠিয়ে দেওয়া একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। বরং মায়ের শরীরের উষ্ণতাই কাজে লাগানো হয় শিশুর চিকিৎসায়। নার্সারিতে থাকলে যা থেকে বঞ্চিত হয় তারা। নার্সারিতে অন্য রুগ্ণ শিশু থাকলে ‘ক্রস ইনফেকশন’-এর ভয়ও থাকে, প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও। কিন্তু আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন নার্সারিই সাধারণত ব্যবহার করা হয় শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে।

Advertisement

মঙ্গলবার দুপুরে সেই ব্যবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে হাসপাতালে বিদ্যুৎ-বিপর্যের জেরে। বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ হয়ে যায় ইনকিউবেটর। এর পরে একটুও দেরি না করে ১৩টি শিশুকে বাঁচাতে মায়েদের শরণাপন্ন হন চিকিৎসকেরা। নিজেদের সন্তানদের বুকে আগলে রেখে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ‘অন্ধকার’-এর সঙ্গে লড়াই চালালেন মায়েরা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কত ক্ষণ রাখা যায় একটি শিশুকে? এনআরএস হাসপাতালের শিশু চিকিৎসক অসীম মল্লিক বলেন, ‘‘এই ক্যাঙারু মাদার পদ্ধতিই আমরা সর্বত্র ব্যবহার করতে বলছি। এতে শিশু তার মায়ের শরীরের তাপে গরম থাকতে পারে। এই ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাখলেও কোনও অসুবিধে নেই।’’

তবে শুধু নিকু নয়, আচমকা বিকট শব্দে গোটা হাসপাতাল অন্ধকারে ডুবে যেতে সব বিভাগের রোগীদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও কর্মীরা। এমনকী, যে সব জুনিয়র চিকিৎসক ডিউটি শেষ করে হস্টেলে চলে গিয়েছিলেন, ফিরে আসেন তাঁরাও। রিজওয়ান আনসারি, মহম্মদ শামসেদের মতো স্থানীয় কিছু যুবকও চলে আসেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। এক জুনিয়র চিকিৎসক সুহৃদ মল্লিক বলেন, ‘‘আলো জ্বলার আগে পর্যন্ত মোবাইল টর্চ, মোমবাতি জ্বালিয়ে সমস্ত ওয়ার্ডে পরিষেবা দিয়েছি।’’

আবার আইসিউ-তে থাকা রোগীদের ‘অ্যাম্বু মেশিন’ (হাতে করে বেলুন পাম্প করে শরীরে অক্সিজেন দেওয়া হয়) দিয়ে প্রাণ বাঁচান চিকিৎসকেরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে তাঁরা সেই কাজ করে গিয়েছেন। আচমকা অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছ’তলায় শল্য বিভাগে থাকা এক রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন সিঁড়ি বেয়েই নীচে নামিয়ে আনা হয় তাঁকে। জাভেদ আলি নামে এক কর্মী বলেন, ‘‘ওঁর নাকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের নল লাগিয়ে চিকিৎসক-কর্মী সকলে মিলে ধরে নীচে নামিয়ে পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে রেখেছিলাম।’’

মঙ্গলবার হাসপাতাল বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কথা জেনেই পরিস্থিতি সামলাতে সেখানে হাজির হন সাংসদ সৌগত রায়, প্রাক্তন বিধায়ক মদন মিত্র থেকে চেয়ারম্যান গোপাল সাহা, চেয়ারম্যান পারিষদ (স্বাস্থ্য) বিমল সাহা ও স্থানীয় সিপিএম বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায়। কিন্তু মানসবাবুর অভিযোগ, পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে তাঁকে হেনস্থা হতে হয়েছিল।

রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পরিস্থিতি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সামাল দিতে ওই দিন সিইএসসি-কে অনুরোধ জানানো হয়। সিইএসসি প্রথমেই দু’টি জেনারেটর নিয়ে আসে। তা দিয়ে আইসিইউ, নিকু ও জরুরি বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত দু’টি জেনারেটরও এনে রাখা রাখে ওই সংস্থা। সারা রাত ধরে কাজ করার পরে বুধবার ভোরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে সিইএসসি কর্তৃপক্ষ, সকলেই বেসরকারি মোবাইল সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করছেন। সিইএসসি-র এক মুখপাত্র জানান, এই ধরনের কেবল বিপর্যয় খুবই মারাত্মক। যেহেতু অন্য সংস্কার কাজের ফলে সিইএসসি-র কেব্‌ল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ফলে সমস্যার উৎস চিহ্নিত করাই খুব কঠিন ছিল। তাই ওই সমস্যার মোকাবিলায় অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে কাজ করা হয়।

যদিও হাসপাতালে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী ওই মোবাইল সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, তাদের খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সিইএসসি-র কেব্‌ল ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। দু’টি একেবারেই পৃথক লাইন। পাশাপাশি, দীর্ঘ দিন সমীক্ষার পরেই কাজ শুরু করা হয়েছিল। তাই ভুলের সম্ভাবনাও কম। তবুও পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement