অনশন ভাঙার পরের দিনই বিধানসভায় মানস ভুঁইয়া। মঙ্গলবার সভা-চত্বরে তাঁকে অভিনন্দন সূর্যকান্ত মিশ্রের। — নিজস্ব চিত্র।
বোঝাপড়া চলছিলই। কান্দির পিস্তল-কাণ্ড এ বার বাম ও কংগ্রেসের মধ্যে দৃশ্যতই সেতু গড়ে দিল বিধানসভায়! শাসক পক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে বিজেপি-র একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য সশরীর অংশ নিলেন না বটে। কিন্তু সভাকক্ষের বাইরে তাঁর অবস্থানও থাকল সরকারের বিরুদ্ধেই। সব মিলে মঙ্গলবারের বিধানসভা প্রায় অলিখিত বিরোধী ঐক্যের ছবি দেখল!
তৃণমূলের মিছিলে নাইন এমএম পিস্তল হাতে নাচ দেখা গিয়েছিল সোমবার মুর্শিদাবাদের কান্দিতে। যা আদতে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। সেখানকার বিধায়ক ও পুরসভার চেয়ারম্যান কংগ্রেসের অপূর্ব সরকার। অধীর চৌধুরীর জেলায় এমন ঘটনার পরে দায় এড়াতে কংগ্রেসের ঘাড়েই দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। বিধানসভায় এ দিন কিন্তু সেই ঘটনার জেরে প্রতিবাদীর মুখ্য ভূমিকা নিয়ে নিল বামফ্রন্ট। আর কৌশলী দূরত্ব বজায় রেখেও একই সুরে বিক্ষোভ চালিয়ে গেল কংগ্রেস।
অধিবেশন শুরু হতেই এ দিন বাম বিধায়কেরা আচমকা নকল পিস্তল নিয়ে হইচই জুড়ে দেন। নকল পিস্তল উপরে তুলে ধরে তাঁরা বোঝাতে চাইছিলেন, এ রাজ্যে আইনের শাসন বলে কিছুই নেই। প্রকাশ্য রাস্তায় পিস্তল নিয়ে মিছিল করেও পার পাওয়া যায়! চলছিল স্লোগান। আর নকল পিস্তল থেকে শোনা যাচ্ছিল ফট ফট করে ‘গুলি’র শব্দ! বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিলেন, ‘‘এ সব কী হচ্ছে! এগুলো আসল না নকল? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! দয়া করে এগুলো সরান!’’ বাম বিধায়কেরা অবশ্য সেই অনুরোধে কান না দিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর পরেই মার্শালকে ডেকে বিধায়কদের কাছ থেকে কিছু খেলনা পিস্তল বাজেয়াপ্ত করে নেন স্পিকার।
প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে কান্দির ঘটনা নিয়ে বিবৃতি দিতে ওঠেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান, ওই ঘটনায় যে দলের যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গেই পার্থবাবু যোগ করেন, যারা পকেটে ইট নিয়ে মিছিল করে পুলিশের উপর আক্রমণ করে, তারাও ছাড় পাবে না! পরিষদীয় মন্ত্রীর ইঙ্গিত ছিল স্পষ্টতই বামেদের নবান্ন অভিযানের দিকে। এতে ফুঁসে ওঠেন বাম বিধায়কেরা। তাঁরা প্রশ্ন করতে থাকেন, কান্দির সঙ্গে নবান্ন অভিযানকে টানা হচ্ছে কেন? ব্যবস্থাই যখন নেওয়া হচ্ছে, তা হলে কান্দিতে তখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি কেন— জানতে চান কংগ্রেস বিধায়কেরা। এই মর্মে তাঁদের মুলতবি প্রস্তাবও খারিজ করে দেন স্পিকার। বিধানসভার ভিতরে তখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন বাম ও কংগ্রেস বিধায়কেরা। আর পিছনে বসে স্মিত হাসছেন বিজেপি-র শমীক! চিত্কার করতে করতে প্রথমে ওয়াকআউট করেন কংগ্রেস বিধায়কেরা। বেশ কিছু ক্ষণ বিক্ষোভ, পার্থবাবুদের সঙ্গে বচসা, হইহট্টগোলের পর সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান বামেরাও।
বাম এবং কংগ্রেস বেরিয়ে যাওয়ার পরে মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বিধানসভার নিয়মাবলির ধারা উল্লেখ করে বলেন, সংসদ বা কোনও রাজ্যের বিধানসভায় একটা সূচ নিয়ে ঢোকার অধিকার নেই যেখানে, ‘অস্ত্র’ নিয়ে বিক্ষোভ সেখানে পুরোপুরি বেআইনি। সঙ্গে সঙ্গে পার্থবাবু প্রস্তাব এনে বিরোধীশূন্য বিধানসভায় বামেদের তিরস্কার করার কথা জানিয়ে দেন। প্রত্যাশিত ভাবেই শাসক দলের সমর্থনে পাশ হয়ে যায় সেই প্রস্তাব। এরও পরে সভায় আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জিরো আওয়ারের পরেই বলতে ওঠেন তিনি। এবং মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন এক বন্ধনীতেই এনে ফেলেছেন বাম-কংগ্রেসকে। বলেছেন, ‘‘সিপিএম-কংগ্রেসের কথায় কি সরকার চলবে? সরকার চলবে তার নিজের নিয়মে।’’
সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ চলাকালীন ডানকুনি থেকে বাধা পেয়ে এক বার বিধানসভায় চলে এসেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা। তাঁর উপস্থিতিতেই সে দিন বিধানসভার লবিতে ভাঙচুর হয়েছিল। বামেদের এ দিনের বিক্ষোভকে ‘গণতন্ত্রের কলঙ্ক’ বলতে গিয়ে সে দিনের ঘটনার জন্য তৃণমূল বিধায়কদের বেতন কেটে নেওয়ার সুপারিশের কথা তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে সভার বাইরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া এবং বিজেপি-র শমীক একই সুরে বিধানসভার লবিতে মমতার উপস্থিতিতে ‘তাণ্ডবে’র কথা মনে করিয়ে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন— খেলনা পিস্তল নিয়ে বিক্ষোভকে তা হলে কোন মুখে ‘কলঙ্ক’ বলা হচ্ছে?
মানসবাবুর অনশন-মঞ্চে সোমবারই বাম বিধায়কদের প্রতিনিধিগল পাঠিয়েছিলেন সূর্যবাবু। অনশন শেষ করে বিধানসভায় উপস্থিত মানসবাবুর সঙ্গে এ দিন লনে দেখা হয়েছিল সূর্যবাবুর। আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছিলেন দু’জনে। এক সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ছড়িয়ে পড়েছিল সেই প্রতীকী দৃশ্য থেকেই!
বোঝাই যাচ্ছে, আলিঙ্গন এখন জারি থাকবে!