সিপিএমের যুবনেতা কলতান দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।
সারা ক্ষণ মুখে লেগে থাকে স্মিত হাসি। রেগে গিয়েছেন, এমনটা খুব একটা দেখা যায় না। কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলছেন, তেমনটাও কেউ মনে করে বলতে পারবেন না। তিনি বাম আন্দোলনকে ‘ফিনিক্স পাখি’র সঙ্গে তুলনা করে কবিতা লিখতে পারেন। সেই তিনিই যে ‘ফাইট টু ফিনিশ’ উচ্চারণ করতে পারেন, বিশ্বাস হচ্ছে না অনেকের।
সিপিএমের যুব নেতা কলতান দাশগুপ্ত গ্রেফতার হওয়ার পরে দলের মধ্যে এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কলতানের পরিচিত চারিত্রিক গঠন এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ। সিপিএমের অনেকেই অনুষ্ঠানিক ভাবে ওই গ্রেফতারকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলছেন। যেমনটা বলেছেন কলতান নিজেও। তবে অনেকে এ-ও বলছেন যে, ‘ফাঁদে’ পা দিয়ে ফেলেছেন ‘কেডিজি’। যা ‘সম্ভাবনার’ সময়ে ‘সর্বনাশ’ ডেকে এনেছে।
একটা সময়ে ফেসবুকে কলতান নিয়মিত প্রেমের কবিতা লিখতেন। কখনও সেই লেখার প্রেক্ষাপটে থাকত মেট্রোয় পাশাপাশি বসা যুগল, কখনও বৃষ্টির বো ব্যারাকের রাস্তায় এক ছাতার নীচে হেঁটে যাওয়া তরুণ-তরুণী। আগুন ঝরানো বিপ্লব নয়। ভরপুর রোম্যান্টিকতা।
পরিচিত কলতান বাগ্মী। কলতান সাবধানি। কলতান রাগেন না। বরং কেউ রেগে গেলে সেই ‘কলতান’ থামান। জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থানে হামলা সংক্রান্ত অডিয়ো ক্লিপে সেই কলতানের নাম জড়ানোয় দলের অনেকেই হতবাক। সত্যি? কলতান?
প্রকাশ্যে সিপিএমের অবস্থান যেমনই হোক, ঘরোয়া আলোচনায় কলতানের সহকর্মীদের অনেকেই বলছেন, কণ্ঠস্বরে মিল রয়েছে। কলতান সরাসরি বলেননি, কণ্ঠস্বর তাঁর, না তাঁর নয়। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী দাবি করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক কল্লোল মজুমদার বলেছেন, কুণাল বিভিন্ন লোককে ওই ভাবে ‘ফোন করিয়ে’ এই সব করেন। অর্থাৎ, কল্লোল ‘এআই’ প্রসঙ্গ তোলেননি। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম রয়েছেন দিল্লিতে। প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরির শেষযাত্রায় অংশ নিতে শনিবার সকালেই তিনি দিল্লি রওনা হন। দুপুরে একটি প্রেস বিবৃতিতে সেলিম কলতানের গ্রেফতারিকে ভীমা কোরেগাঁওয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেলিম লিখেছেন, ‘ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বিজেপি সরকার যে কাজ করেছে, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার সেই পথই অনুসরণ করছে।’ কলতানের সংগঠন ডিওয়াইএফআই, সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই এবং মহিলা সংগঠন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি অবশ্য তাদের যৌথ বিবৃতিতে ‘এআই’ ব্যবহার বা ষড়যন্ত্রের কথা বলেনি। এ-ও বলেনি যে, অডিয়ো ক্লিপের কণ্ঠস্বর কলতানের নয়। তাদের বক্তব্য, আন্দোলন ভাঙার জন্যই কলতানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কলতানের গ্রেফতারির প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে থানা অভিযান হবে বলেও ঘোষণা করেছেন মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়েরা।
জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নায় হামলার আশঙ্কা সংক্রান্ত একটি ফোনালাপের অডিয়ো শুক্রবারই প্রকাশ্যে এসেছিল (যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ ওই অডিয়ো প্রকাশ্যে আনার সময়েই ফোনালাপের দু’জন ব্যক্তির এক জনকে ‘স’ এবং অপর জনকে ‘ক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক জন অতি বাম যুব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এবং অপর জন বাম যুব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করেছিলেন রাজ্যসভার প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ। শুক্রবারেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন এক অভিযুক্ত সঞ্জীব দাস। সঞ্জীবের নামের আদ্যক্ষর ‘স’। তার পর থেকেই আলোচনা শুরু হয়েছিল ‘ক’ নিয়ে। ফোনালাপের অডিয়ো প্রকাশ্যে আসার পর থেকে বামেদের অন্দরেও ‘ক’ নিয়ে বিভিন্ন জল্পনা শুরু হয়েছিল। শেষে ‘ক’-এর পরিচয় প্রকাশ্যে আসে। বিধাননগর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন সিপিএমের যুব নেতা কলতান (ক)।
সাউথ সিটি কলেজে পড়ার সময়ে এসএফআইয়ে যোগ দেন কলতান। তার পর যুক্ত হন যুব সংগঠনে। সিপিএমের সর্ব ক্ষণের কর্মী তিনি। দলীয় সূত্রে খবর, কলতানের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তিনিও ডিওয়াইএফআই কলকাতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। আনুষ্ঠানিক ভাবে কলতানের গ্রেফতারিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসাবেই দেখাচ্ছে বামেরা। তবে ঘরোয়া আলোচনায় অনেকেই মনে নিচ্ছেন, অডিয়ো ক্লিপ-কাণ্ডে কলতানের নাম জড়িয়ে যাওয়া দলের কাছে ‘ধাক্কা’। বিশেষত, এমন একটি সময়ে। তবে যাঁরা মনে করতে চাইছেন বিষয়টি প্রযুক্তিগত নকশা করে বানানো, তাঁদের দাবি, সত্য ঠিক প্রকাশ্যে আসবে। আপাতত সিপিএম কলতানের পাশেই দাঁড়াচ্ছে। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘কলতান বিষয়টিতে যুক্ত না কি যুক্ত নন, সেটা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু এখন যদি ওঁর পাশে পার্টি না দাঁড়ায়, তা হলে অন্য কর্মীদের কাছে ভুল বার্তা যাবে।’’
হতে পারে। সম্ভবত সে কারণেই সমাজমাধ্যমে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা পোস্টার ছড়িয়ে দিয়েছেন, ‘জনতার কলতান থামবে না’।