বন্ধ নিয়ে মামলাকারীকে ভর্ৎসনা প্রধান বিচারপতির। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
বিজেপির ডাকা ১২ ঘণ্টার বাংলা বন্ধের বিরোধিতা করে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন এক আইনজীবী। বুধবার কলকাতা হাই কোর্ট তাঁকে জানিয়ে দিল, তিনি আজীবন আর জনস্বার্থ মামলাই করতে পারবেন না। একই সঙ্গে তাঁর করা অন্য একটি জনস্বার্থ মামলার জন্যও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে বলা হল ওই আইনজীবীকে! বুধবার ওই নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম। মামলাকারীকে ভর্ৎসনা করে তিনি বলেছেন, ‘‘নির্দিষ্ট অভিসন্ধি নিয়ে অসত্যভাষণ করে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের অপব্যবহার করা হয়েছে মামলাটিতে। আপনি কি আদালতকে খেলার মাঠ আর বিচারপতিদের বোকা ভেবেছেন?’’
ঘটনার সূত্রপাত মঙ্গলবার রাতে। মঙ্গলবার বিকেলে বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছিল বিজেপি। সেই বন্ধকে বেআইনি বলে সমালোচনাও করেছিল নবান্ন। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট এবং বিভিন্ন হাই কোর্টের বন্ধ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণও তুলে ধরা হয় রাজ্য সরকারের তরফে। এর পরেই রাতে বিজেপির ডাকা বাংলা বন্ধের বিরোধিতা করে কলকাতা হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করা হয়। মামলাটি করেছিলেন সঞ্জয় দাস নামে এক আইনজীবী। তিনি ওই মামলায় প্রধান বিচারপতির দফতরকে উল্লেখ করে মামলাটি দ্রুত শুনানির আর্জি করেন। তাঁকে জানানো হয়, প্রধান বিচারপতি বুধবার সকাল ১১টায় ওই মামলা শুনবেন। একই সঙ্গে মামলাকারী আইনজীবীকে বলা হয়, শুনানির সময়ে যেন তিনি অবশ্যই উপস্থিত থাকেন।
বুধবার যথাসময়ে মামলাটির শুনানি শুরু হয়। আদালতে উপস্থিত হন মামলাকারী আইনজীবী সঞ্জয়ও। মামলাটি ওঠে প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের বেঞ্চে। মামলাটির প্রাথমিক ভূমিকা শোনার পরেই বেঞ্চ মামলাকারীকে কিছু প্রশ্ন করে।
প্রধান বিচারপতি: আপনি হলফনামায় লিখেছেন, আপনি একজন জনহিতকারী এবং জনদরদি হিসাবে বন্ধের বিরোধিতা করে এই জনস্বার্থ মামলা করেছেন। এ-ও জানিয়েছেন, আমি সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেন। তাঁদের জন্য কাজ করেন। দরিদ্রদের জন্য কাজ করেন।
মামলাকারী আইনজীবী: হ্যাঁ।
প্রধান বিচারপতি: আপনার করা একটিও জনকল্যাণকর কাজের উদাহরণ দিতে পারবেন?
মামলাকারী: (নীরব)
প্রধান বিচারপতি: আপনি কত বছর ধরে রয়েছেন আইনের পেশায়?
মামলাকারী: দশ বছর।
প্রধান বিচারপতি: এই দশ বছরে কোনও জনকল্যাণকর কাজ করেননি! অথচ বলছেন জনহিতকারী, জনদরদি? দাবি করেন দরিদ্র মানুষের কথা ভেবেছেন!
মামলাকারী: (নীরব)
প্রধান বিচারপতি: আপনি আমপান ঝড়ের সময় কোনও জনকল্যাণকর কাজ করেছেন?
মামলাকারী: না।
প্রধান বিচারপতি: আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করছেন? বিচারপতির কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন? সমাজের প্রতি আপনার অবদান কী?
মামলাকারী: (নীরব)
প্রধান বিচারপতি: কাল (মঙ্গলবার) মামলা করে আমার কার্যালয়কে উল্লেখ করে বললেন জরুরি ভিত্তিতে শুনতে হবে। এমন করলেন যেন, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে! আমরা ওই জন্যই আপনাকে উপস্থিত থাকতে বলেছিলাম। আমরা বোকা নই। আদালতে আমরা বোকার মতো বসে নেই। আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে এ ভাবে খেলা করবেন না। এই মামলা খারিজ করাই উচিত।
মামলাকারী: (নীরব)
প্রধান বিচারপতি: আগে আইন সম্পর্কে অবগত হন। এটা খেলার মাঠ নয়। এই আদালতকে ফুটবল মাঠ ভেবে নিলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না। এটা কোনও দায়িত্বশীল আচরণ নয়। আপনি আদালতে অসত্য তথ্য দিচ্ছেন! আদালত আপনাকে জনস্বার্থ মামলা করার অধিকার থেকে বিরত করল। ভবিষ্যতে আর কখনও জনস্বার্থ মামলা করতে পারবেন না।
মামলাকারী আইনজীবী সঞ্জয় এর আগে আরও একটি মামলা করেছিলেন হাই কোর্টে। সেই মামলাও ছিল জনস্বার্থ মামলা। মামলাটির বক্তব্য ছিল পুলিশি সক্রিয়তার যে মামলা বিচারপতি অমৃতা সিংহের এজলাসে চলছে, তা তাঁর এজলাস থেকে সরানো হোক। বন্ধ সংক্রান্ত মামলা শুনতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি সেই মামলার প্রসঙ্গও টেনে আনেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে হাই কোর্টের শেষ কথা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিই বলবেন। আপনি প্রধান বিচারপতিকে তাঁর দায়িত্ব শেখাচ্ছেন। হাই কোর্টে কার এজলাসে কোন মামলার শুনানি হবে, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির। আপনি তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করছেন?’’ এর পরেই বিচারপতি সিংহের বিরুদ্ধে করা জনস্বার্থ মামলাটিতেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় ওই আইনজীবীকে। পাশাপাশি, খারিজ হয়ে যায় তাঁর করা দু’টি জনস্বার্থ মামলাই।