হাইকোর্টে মুখোমুখি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় (বাঁ দিকে) এবং আইনজীবী অরুণাভ (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের ‘অম্ল-মধুর’ সম্পর্ক আগেই দেখেছে কলকাতা হাই কোর্ট। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এবং আইনজীবী ঘোষের বচসা গড়িয়েছিল আদালতের বাইরেও। বৃহস্পতিবার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে ফের তর্কে জড়ালেন দু’জনেই। বিচারপতিকে ‘আইন জানেন না’ বলে আক্রমণ করলেন আইনজীবী। অন্য দিকে আইনজীবকে ‘জেলে ঢোকানোর’ হুমকি দিলেন বিচারক। তবে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শেষে অরুণাভকে বিচারপতির উদ্দেশে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আপনি এক জন সৎ মানুষ।’’
বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটে নাগাদ হাই কোর্টে টেট মামলার শুনানি শুরু হওয়ার কথা ছিল। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই হাসিমুখে ভিড় থিকথিকে এজলাসে এলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সবাই উঠে দাঁড়ান। এর পরেই বিচারপতি বললেন, ‘‘আজ আমি মামলা শুনব না, শরীরটা ভাল না। অরুণাভ কোথায়?’’
তখনই গান গেয়ে ওঠেন অন্য আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়— ‘‘তুমি আসবে বলেই কোর্টে রুমে এত ভিড় হয়ে গেল...’’ এর পর অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে সুকন্যার আইনজীবী অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আপনিও নাকি ভাল গান করেন!’’
সেই এজলাসে প্রবল ভিড়। যা নিয়ে অরুণাভ বলেন, ‘‘আদালত যেন ছাতুবাবুর বাজার হয়ে গিয়েছে। এত ভিড়!’’ এর পর পরই অরুণাভ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্দেশে আচমকা বলেন, ‘‘আপনি আইন জানেন না। আপনাকে কী করে ডিল করতে হয় জানি। সাংবাদিকরা আপনার চেম্বারে যান। আপনি অনেক কথা বলেন।’’
বিচারপতি তখন আদালতে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে জানান, এই ঘটনার ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা যাবে। তিনি বলেন, ‘‘লাইভস্ট্রিমিং করা যাবে না, সকলে ভিডিয়ো করতে পারেন।’’ তার পরেই অরুণাভের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি তো সংবাদমাধ্যমে অনেক কিছু বলেছেন, এই নিয়ে রুল জারি করে জেলে পাঠাব। আমার শরীর ভাল না, আসতাম না। কিন্তু না আসলে অনেকে ভাবত আমি ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছি। তাই এলাম।’’
তার পরেই বিচারপতি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেন। বুধবার তিনি যে সব নির্দেশ দিয়েছিলেন (অনুব্রতের মেয়ে-সহ ছ’জনের হাজিরা, টেট সার্টিফিকেট এবং নিয়োগপত্র পেশ) তা প্রত্যাহার করেন তিনি। শেষে বিচারপতি হেসে অরুণাভের উদ্দেশে হাতজোড় করেন। বাকি আইনজীবীরা অরুণাভকে বলেন, ‘‘আপনি উঠে দাঁড়ান।’’ শুনে অরুণাভও উঠে দাঁড়িয়ে হাসেন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এবং অরুণাভর মধ্যে এমন বাক্যালাপ আগেও দেখা গিয়েছে। গত জুন মাসেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন রায় সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্য করেন অরুণাভ। সেই মন্তব্য প্রসঙ্গে গত ২৩ জুন হাই কোর্টে কটাক্ষ করেন বিচারপতি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এক জ্যাঠামশাই আইনজীবী যেখানে সেখানে বলে বেড়াচ্ছেন অভিজিৎবাবু এটা করেননি, অভিজিৎবাবু ওটা করেননি। আমি নাকি আইনের এবিসিডি বুঝি না! আদালতের ওই জ্যাঠামশাই কি আইনের এবিসিডি জানেন? এত দিনে জ্যাঠামশাইয়ের পারফরম্যান্স সবাই জানে। আমি আইনের এ টু জেড না-ই জানতে পারি কিন্তু এবিসিডি ভাল করেই জানি।’’
ঘটনার সূত্রপাত এসএসসি মামলার একটি শুনানিতে হাই কোর্টের এজলাসে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথন চলাকালীন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পত্তির প্রসঙ্গ উঠেছিল। সেই সময় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘কোনও দিন সুযোগ হলে গাঁধী পরিবারের সম্পত্তির হলফনামাও দেখব।’’ ওই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতা তথা আইনজীবী অরুণাভ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেন। বিচারপতি আইন জানেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ওই তিনি।
তবে সেই লড়াই থেমে গিয়েছিল হাই কোর্টেই। গত ২৯ জুন নিজের এজলাসেই ফের ‘জ্যাঠামশাই’ প্রসঙ্গ টেনে আনেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। আইনজীবী সুপ্রতীক রায়ের উদ্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সে দিন বলেছিলেন, ‘‘অরুণাভ ঘোষকে গিয়ে বলুন এই কোর্টে পায়ের ধুলো দিয়ে যেতে। আমার প্রতি কী ক্ষোভ রয়েছে? আমাকে এসে বলুন। আমি মাথা নিচু করে শুনব।’’
তার পর অরুণাভ আদালতে এলে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথন ছিল এই রকম—
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আপনার প্রতি আমার কোনও ক্ষোভ নেই।’’
আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, ‘‘ক্ষোভ থাকলেই ভালবাসা হবে। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।’’
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আপনি বর্ষীয়ান আইনজীবী। যা হয়েছে ভুলে যান। আমি কিছু মন্তব্য করেছি। ভুলে যান। আমি তুলে নিচ্ছি।’’
অরুণাভ বলেন, ‘‘আমি কিছু মনে রাখি না।’’
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমি আমার মন্তব্য তুলে নিচ্ছি। কল্যাণদার (কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়) কাছে বলেছি। ভালবাসা থাকুক। ক্ষোভ রাখবেন না। যা হয়েছে ভুলে যান। আমিও ভুলে যাচ্ছি।’’
তবে বৃহস্পতিবার এজলাসে বিচারপতিকে ফের ঝাঁঝ দেখালেও শেষমেশ অরুণাভ বলেন, ‘‘আপনি যে সৎ মানুষ তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই।’’