পাড়ুইয়ের পরে তাপস পাল-মামলা। রাত পোহাতেই আদালতের আঙিনায় শাসকদল তথা রাজ্য সরকার ফের বিড়ম্বনায়। দুইয়ের মূলে একই ঘটনা গুরুতর অভিযোগের হাত থেকে শাসকদলের নেতা-জনপ্রতিনিধিকে আড়াল করতে প্রশাসনিক সক্রিয়তা ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা। এবং দুই মামলাতেই মোটামুটি একই সুরে আদালত তোপ দেগেছে রাজ্য সরকারের দিকে।
বীরভূমের পাড়ুইয়ে সংগঠিত সাগর ঘোষ হত্যা সংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে বুধবার তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে আড়াল করার জন্য রাজ্য পুলিশকে দুষেছে কলকাতা হাইকোর্ট। খোদ রাজ্য পুলিশের ডিজি’র উপরে চরম অনাস্থা প্রকাশ করে বিচারপতি পাড়ুই-তদন্তের ভার সঁপেছেন সিবিআইয়ের হাতে। আর বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের উস্কানি-উক্তি সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্ট পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার নালিশকেই মান্যতা দিয়ে সাংসদের বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল করতে বলেছে। পর পর দু’দিনের এ হেন জোড়া ধাক্কাতেই অস্বস্তির পালা
শেষ হল, সে নিশ্চয়তাও নেই। কারণ, এই মুহূর্তে আরও একটি পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার মামলা হাইকোর্টের বিচারাধীন, যাতে মূল অভিযুক্ত হলেন লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। অভিযোগ, সিপিএম সমর্থক তিন ভাইকে পিটিয়ে মারার মামলাটিতে দল তথা প্রশাসনের ‘রক্ষাকবচে’ মনিরুল বলীয়ান।
লাভপুর নিয়েও তাই তৃণমূল ভবন উদ্বেগে রয়েছে। হাইকোর্ট-সূত্রের অবশ্য ইঙ্গিত, পুজোর আগে এর নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কম। কিন্তু পাড়ুইয়ের পরে তাপস-মামলাতেও আদালত এ দিন যে ভাষায় সরকারের সমালোচনা করল, তা দল ও সরকারকে বিব্রত করার পক্ষে যথেষ্ট বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। বুধবার পাড়ুই-কাণ্ডে বিচারপতি হরিশ টন্ডনের রায়টি কার্যত ওই মামলায় বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের দেওয়া নির্দেশের প্রতিরূপ। একই ভাবে এ দিন তাপস-কাণ্ডে বিচারপতি নিশীথা মাত্রের নির্দেশটি বহুলাংশে মিলে গিয়েছে এই মামলায় বিচারপতি দত্তের রায়ের সঙ্গে। তাপস-মামলায় ২৮ জুলাই বিচারপতি দত্তের দেওয়া নির্দেশের মূল অংশটি অক্ষতই রেখেছেন বিচারপতি মাত্রে। ফারাক শুধু দু’জায়গায়। কী রকম?
নদিয়ার নাকাশিপাড়া থানা-এলাকায় একাধিক সভায় উস্কানিমূলক মন্তব্য করে তাপস পাল আদালতগ্রাহ্য অপরাধ করেছেন বলে জানিয়ে বিচারপতি দত্ত সে দিন নাকাশিপাড়া থানাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে সাংসদের বিরুদ্ধে এফআইআর রুজু করে মামলা শুরু করতে হবে। তাঁর নির্দেশ ছিল, হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে সিআইডি ঘটনার তদন্ত করবে। বিচারপতি মাত্রেও তাপস-কাণ্ডে এফআইআর রুজু এবং সিআইডি-তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এফআইআর দাখিলের কোনও সময়সীমা তিনি বেঁধে দেননি। পাশাপাশি জানিয়েছেন, আদালতের নজরদারি ছাড়াই সিআইডি স্বাধীন ভাবে তদন্ত করবে। সিআইডি-তদন্তে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করে বিচারপতি মাত্রের মন্তব্য, “আমার বিশ্বাস, সিআইডি-র তরফে যিনি তদন্তকারী অফিসার হবেন, তিনি ঠিক ভাবে তদন্ত করার যাবতীয় চেষ্টা চালাবেন। আশা করি, সেই তদন্ত তাপস পালকে নির্দোষ প্রমাণ করার লক্ষ্যে হবে না। তদন্ত হবে অবাধ।”
এবং মাত্রে-নির্দেশের এই অংশটিকে দেখিয়েই সরকারপক্ষের কৌঁসুলি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, মামলায় রাজ্য সরকারেরই জয় হয়েছে। “বিচারপতি দত্ত চেয়েছিলেন, হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণে সিআইডি তদন্ত করুক। বিচারপতি মাত্রে তা মানেননি। আমরা যা চেয়েছিলাম, সেটাই হয়েছে।” —এ দিন যুক্তি দিয়েছেন কল্যাণবাবু, যিনি তাপস পালের অপরাধ আদৌ আদালতগ্রাহ্য নয় বলে মাত্রে-এজলাসে সওয়াল করেছিলেন।
পাড়ুই-মামলায় রাজ্য বিচারপতি হরিশ টন্ডনের রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। তাপস-মামলায় কী করবে?
ঘটনা হল, এ ক্ষেত্রে আর ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হওয়ার যো নেই। কারণ, বিচারপতি দত্তের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার আগেই ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করেছিল। সেখানে দুই বিচারপতির মতভেদের দরুণ মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হয়েছিল তৃতীয় বিচারপতি নিশীথা মাত্রের আদালতে। তাই মাত্রে-নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে রাজ্যকে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টেই যেতে হবে। ওই পদক্ষেপ রাজ্য করবে কি না, সে ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিত এ দিন সরকারি তরফে মেলেনি। এ দিনের রায়ের পরে হাইকোর্টের এক আইনজীবীর মন্তব্য, “তাপস-মামলায় রাজ্য ৩-১ গোলে হেরে গেল। তিন বিচারপতিই (সিঙ্গল বেঞ্চের দীপঙ্কর দত্ত, ডিভিশন বেঞ্চের তপোব্রত চক্রবর্তী ও তৃতীয় বেঞ্চের নিশীথা মাত্রে) সাংসদের উক্তিকে আদালতগ্রাহ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন। বিপক্ষে ছিলেন শুধু এক জন ডিভিশন বেঞ্চের প্রথম বিচারপতি গিরীশ গুপ্ত।”
গত ১৪ জুন তাপস পাল তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের পাঁচ জায়গায় উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশ করার পরেও পুলিশ সক্রিয় না-হওয়ায় এবং তাপসের উক্তির বিরুদ্ধে দাখিল অভিযোগগুলিকে এফআইআরের মর্যাদা না-দেওয়ায় বিরাটির এক বাসিন্দা হাইকোর্টে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার মামলা করেছিলেন। সিঙ্গল বেঞ্চ, ডিভিশন বেঞ্চ ঘুরে শেষমেশ তৃতীয় এক বিচারপতির এজলাসে যে ভাবে তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল, কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাসে তেমন নজির নেই বলেই দাবি করছেন আইনজীবীরা। তৃতীয় বিচারপতি মাত্রের এজলাসও শাসকদলের সাংসদের প্রতি রাজ্য প্রশাসনের ‘পক্ষপাত’ নিয়ে সংশয়ে ছিল। “মনে হচ্ছে, রাজ্যের ভূমিকা হল আড়াল করার। শাসকদলের সাংসদ বলেই কি সরকার ব্যাপারটা চাপা দিতে চাইছে?’’ ১০ সেপ্টেম্বর শুনানিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতি মাত্রে। তাঁর এ-ও পর্যবেক্ষণ ছিল, “এখানে এখন সাধারণ লোকে ইন্টারনেটে কিছু আপলোড করলে পুলিশ ধরছে! আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে!” বস্তুত শাসকদলের সাংসদ হওয়ার সুবাদে তাপস পালের পক্ষে যে তদন্তকে প্রভাবিত করা বিলক্ষণ সম্ভব, বিচারপতি সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, “আদালত চায়, তদন্ত দ্রুত সেরে ফেলা হোক।” এত কিছুর মূলে যিনি, তিনি কী বলছেন?
যোগাযোগ করা হলে তাপসবাবু এ দিন জানান, তিনি অসুস্থ, কলকাতার বাইরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে মন্তব্য এড়িয়ে তৃণমূল সাংসদের প্রতিক্রিয়া, “আমি তো আমার বক্তব্য আগেই জানিয়ে দিয়েছি! চিঠি লিখে বলেছি। দয়া করে আর ফোন করবেন না।” তাপসবাবুর দলের তরফে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আদালতের নির্দেশ নিয়ে আমরা দল হিসেবে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।” আর রাজ্য সরকারের তরফে আইন ও বিচারমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “সরকার জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে। সরকার সকলের। হাইকোর্ট সিআইডি’কে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। আদালতের নজরদারিতে তদন্ত করার নির্দেশ নেই। সেই মতো তদন্ত করবে সিআইডি।” বিরোধীরা স্বভাবতই হাইকোর্টের রায়কে হাতিয়ার করেছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “রাজ্য সরকার ফের আদালতে চপেটাঘাত খেল। রায়ে স্পষ্ট, আদালত তাপসবাবুকে প্রাথমিক ভাবে দোষীই মনে করছে।”
অন্য দিকে ১৪ জুন নদিয়ার যেখানে যেখানে সাংসদ এই সব মন্তব্য করে বিতর্কের জালে জড়িয়েছেন, সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকে কিন্তু হাইকোর্টের রায়কে যথেষ্ট মনে করছেন না। তাঁরা চাইছেন, পাড়ুইয়ের মতো এখানেও তদন্ত করুন কেন্দ্রের গোয়েন্দারা।