নদীর জলে ভেসে যাচ্ছেন মানুষ। চলছে উদ্ধারের চেষ্টা। পিটিআই
জল নেই আর কোমর জল, এই দুইয়ের মাঝে ব্যবধান মিনিট দশও নয়। শুকনো খটখটে নদীতেই চার থেকে পাঁচ মিনিটে তুমুল জলস্রোত চলে আসে। নদীর পাড়ের বাসিন্দারা এই খামখেয়ালি জলপ্রবাহকে ‘পাগলা বান’ বলে থাকেন। বিপর্যয় সংক্রান্ত পরিভাষায় এর নাম ‘হড়পা বান’। যে বান দশমীর বিসর্জনের সন্ধ্যায় মাল নদীতে আট দর্শনার্থীর প্রাণ কেড়েছে। তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, ডুয়ার্সের শুকনো নদীগুলিতে এমন বান ডাকার সম্ভাবনা কতটা?
স্থানীয় লোকজন যতই একে ‘পাগলা বান’ বলুন না কেন, পাহাড়ি নদীতে হঠাৎ করে জল নেমে আসে প্রাকৃতিক কারণেই। তবে হড়পা বান কেন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তা নিয়ে নানা দাবি রয়েছে। অনেকেরই মতে, নদীখাত থেকে অপরিকল্পিত ভাবে বালি-পাথর তোলার কারণে এই ঘটনা ঘটে। মালবাজারের বিপর্যয় নিয়েও বিজেপির জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায় এবং তাঁর দলের সতীর্থেরা দাবি করেছেন, বালি-পাথর ‘চুরি’ করে নদীখাত থেকে তোলার ফলেই নদীতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। যদিও এই অভিযোগ অনেকটাই উড়িয়ে দিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা। যে পাহাড়ি নদীতে বালি-পাথর তোলা হয় না, সেখানেও হড়পা বান আসে। কার্যত, হড়পা বান নিয়ন্ত্রণ বা যথাযথ পূর্বাভাসও সম্ভব নয় বলে দাবি। উঁচু পাহাড়ে মেঘভাঙা বৃষ্টি হলে তার পূর্বাভাস সম্ভব নয়। কোথাও জমে থাকা জলও হঠাৎ নেমে এসে নদী ভাসিয়ে দেয়।
এর আগে এই মাল নদীতেই একাধিক হড়পা বান হয়েছে। দেড় দশক আগে এক সেনা আধিকারিকের পরিবার এই নদীতে তলিয়ে গিয়েছিল। এ বারও মহালয়ার একদিন আগে বালি তুলতে গিয়ে ভেসে যায় আস্ত একটি লরি। তার আগে, গত জুনে ডুয়ার্সের গাঠিয়া ঝোরায় হড়পা বানে সেই গাঠিয়া চা বাগানেরই সহকারী ম্যানেজারের স্ত্রী-সন্তান ভেসে যান। পরে সাত কিলোমিটার দূরে তাঁদের দেহ উদ্ধার হয়। জুলাইয়ে কুর্তি নদীতে হড়পা বানে ভেসে আসে বুনো হাতির শাবক। জীবিত সেই শাবকটিকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করেন।
আপাত শুকনো পাহাড়ি নদীর বুকে নেমে ছবি তোলার অভ্যাস পর্যটকদের দীর্ঘদিনের। বিপদ সেখানেই। পা হড়কে পড়ে গিয়ে ২০২০ সালে গরুবাথানের চলেখোলায় মৃত্যু হয় এক কিশোরের। ২০২০ সালেই রকি আইল্যান্ডের পাহাড়ি মূর্তি নদীতে তলিয়ে যান এক সিভিক ভলান্টিয়ার।
পরিবেশবিদ তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান সুবীর সরকার বলেন, ‘‘মাল নদীতে এর আগেও এ ধরনের হড়পা বানের ঘটনা ঘটেছে। তাতে বন দফতরের তৈরি মালবাজার উদ্যান পুরো নষ্ট হয়েছিল।’’ তিনি জানান, মাল নদীতে হড়পা বানের প্রধান কারণ, এই নদীর ‘ক্যাচমেন্টে’ মিশন হিলস অঞ্চল, যা বাগরাকোটের উপর দিকে হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে। এখানে ‘হাই ইনটেনসিটি’ তথা অল্প সময়ে ব্যাপক মাত্রায় বৃষ্টিপাত হয় মাঝেমাধ্যে। এবং আয়তনে ছোট ‘ক্যাচমেন্ট’ অঞ্চলে ওই ধরনের বৃষ্টিপাত ঘটলে (যা মালবাজার শহর থেকে বেশি দূরে নয়) বৃষ্টির পরে অল্প সময়েই প্রবল জলোচ্ছ্বাস হয়ে নেমে আসে। এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে পাহাড়ের জল নেমে সমতলের নদীকে ভাসিয়ে দিতে পারে।